‘মিশন এ প্লাস’ গ্রুপে পাঁচ হাজার টাকায় মেলে এইচএসসির প্রশ্ন সঙ্গে জিপিএ ৫

Image

এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চলে আসে তার ছবি, পর্যায়ক্রমে সমাধানও। পরীক্ষা কেন্দ্রের কক্ষে বসেই স্মার্টফোনে পাওয়া সেই সমাধান দেখে উত্তরপত্রে লেখেন পরীক্ষার্থীরা। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন অন্তত ৯টি হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপ যেখানে পরীক্ষা শুরুর আগেই মিলছে প্রশ্নপত্র।

এর মধ্যে অন্যতম ‘মিশন এ প্লাস’ ও ‘রাসেলস ভাইপার’ এই গ্রুপ দুটিতে বিজ্ঞান বিভাগের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। এতে যুক্ত আছে বিজ্ঞান বিভাগের প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী। একইভাবে ‘করোনা ভাইরাস’ নামে আরও একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এমন কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই গ্রুপটিতে মানবিক বিভাগের প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হয়। মাত্র দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে এভাবেই উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা দিচ্ছে একটি কেন্দ্রের প্রায় এক হাজার পরীক্ষার্থী!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার দুর্গম এক জনপদ মনসুর নগর ইউনিয়ন। এখানে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতকের জন্য একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ। তার পাশেই এম মনসুর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টিই অত্র অঞ্চলের এইচএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র। যা শুধুমাত্র করা হয়েছে ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের জন্য। দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় উপজেলা সদর থেকে এই কেন্দ্রে সড়ক ও নৌপথে পৌঁছাতে সময় লাগে চার থেকে ছয় ঘণ্টা। ফলে উপজেলা প্রশাসন ও শিক্ষা অফিস থেকে কেউ কেন্দ্র পরিদর্শনে যান না বললেই চলে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রটিকে ঘিরে গত ছয় বছর ধরে যেন চলছে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে নকল বাণিজ্যের উৎসব।

গত পহেলা জুলাই টাকা দিয়ে পরীক্ষার্থী পরিচয়ে ‘মিশন এ প্লাস’ গ্রুপে যুক্ত হন দেশ রূপান্তরের এই প্রতিবেদক। পরদিন ছিল বাংলা দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরুর কিছু সময় আগেই ওই গ্রুপে প্রশ্নপত্র ও এর আংশিক উত্তর দিয়ে দেয় ‘মিশন এ প্লাস’ ও ‘রাসেলস ভাইপার’ গ্রুপের নিয়ন্ত্রক শাকিল রানা। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া হয়। একই চিত্র ছিল ‘রাসেলস ভাইপার’ গ্রুপের ক্ষেত্রেও। এই গ্রুপেও প্রশ্ন ও উত্তর দেয় শাকিল। গ্রুপ দুটির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে চারজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে। যারা সবাই শাকিলের নির্দেশ মেনে চলে।

প্রশ্নফাঁস, গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ ও সমাধান দেওয়ার বিষয়ে চক্রের প্রধান শাকিল রানার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। গ্রুপের অ্যাডমিনে থাকা তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করলে অভিযোগ শুনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখেন। এর প্রায় আধা ঘণ্টা পরে নিজেই কল করে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘আপনি যে শাকিলের কথা বলছেন আমি সেই শাকিল নই। আমি এ সবের সঙ্গে যুক্ত না।’ তাহলে প্রশ্নফাঁসের গ্রুপগুলোতে তার ফোন নম্বর অ্যাডমিনে আছে কীভাবে জানতে চাইলে শাকিল বলেন, ‘সেটা আমি জানি না।’

কেন্দ্রটির সার্বিক চিত্র তুলে ধরে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি সিরাজগঞ্জের এডিসিকে জানানো হয়েছে। আমরা চেয়ারম্যান স্যারের (বোর্ড চেয়ারম্যান) সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’

এভাবে অবাধে প্রশ্নফাঁস ও নকল করে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকায় প্রতি বছরই ভালো ফলাফল করে আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ কারণে পাসের জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার শিক্ষার্থীরাও নদী পার হয়ে এই কলেজে পড়তে আসেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি না জানলেও কেন্দ্রে যে মোবাইল ফোন দেখে পরীক্ষা দেওয়া যায় তা এলাকার সবাই জানেন। তবে এগুলো নিয়ে কেউ মুখ খোলেন না শুধু এই ভয়ে যে, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ জানতে পারলে কেন্দ্র বাতিল করে দেবে।

এদিকে দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানের পর বদলাচ্ছে চিত্র। গত রবিবার ছিল ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা। এরই মধ্যে দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানের খবর পাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় প্রশাসন। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, কেন্দ্রে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। কেন্দ্রের বাইরে লাল পতাকা দিয়ে নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে সীমানা। প্রত্যেকটি পরীক্ষার্থীর শরীর তল্লাশি করে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়। পরীক্ষার্থীদের কাছে থাকা কয়েকশ স্মার্টফোন সাময়িক সময়ের জন্য জব্দ করা হয়। আর মোবাইল ফোনসহ কেন্দ্রে ঢোকায় ১১ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া প্রশ্নফাঁস ও নকল বাণিজ্যের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি।

বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে দোষীদের আইনানুগ শাস্তি দেওয়া হবে।’

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।