দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করা হলে সামনের দিকে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম আসবে তার মধ্যে অন্যতম রাজধানীর সেইন্ট যোসেফ, সেইন্ট গ্রেগরী, সেইন্ট জেভিয়ার্স কিংবা হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। আর দেশের স্বনামধন্য এসব শিক্ষালয় পরিচালনা করছেন ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের যাজক ও সংঘের সদস্যরা। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, দেশ-বিদেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান কিংবা সামনের সারিতে থাকা, শীর্ষ সরকারি-বেসরকারি চাকরি কিংবা অন্য যেকোনো সূচকে সামনের সারিতেই থাকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নাম।
মূলত ভিন্নধর্মী পাঠদান কৌশল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুসম্পর্ক, শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশসহ নানা ভালো প্রথম সারিতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষায়ও এগিয়ে রয়েছে এসব শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সুযোগ থাকে না কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততারও; ফলে শিক্ষাই হয় এখানকার মূল আয়োজন। হাতে-কলমে শেখার ধারণা কিংবা বাণিজ্যিকীকরণের বাইরে গিয়ে শিক্ষাকে জাতি গঠনের একটি বড় সেবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে মিশনারি সন্ন্যাস সংঘ পরিচালিত এ শিক্ষালয়গুলো।
বাংলাদেশে মিশনারি শিক্ষার ইতিহাস
বর্তমান বাংলাদেশ এবং পূর্ববর্তী ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার খবর পাওয়া যায় ৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৫ শতকের দিকে পর্তুগিজরা যখন এই উপমহাদেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসে তখন তাদের সাথে আসে একদল খ্রিষ্টান ধর্মযাজকও।
এরপর ১৪৯৮ সালের ২০মে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ভারতের কালিকট বন্দরে নোঙর করলে বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয় খ্রিষ্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারও। এসময় ধর্মীয় প্রচার কৌশলের অংশ হিসেবে এবং প্রচলিত সমাজ বাস্তবতায় তারা বেশ কিছু সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ক্ষেত্রবিশেষে যাকে এই অঞ্চলের বিকাশের বড় পরিবর্তনের দিক বলা যায়; শিক্ষা তার অন্যতম।
রাজধানী ঢাকায় প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই; ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়টি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম সরকারি স্কুল। এটি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ব্যাপস্টিক মিশনারি ওয়েন লিওনার্দোর। আর ১৮১৬ সালে ঢাকায় খ্রিষ্টান শিশুদের জন্য প্রথম প্রথাগত বিদ্যালয় চালু করা হয়। ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ মূলত একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে এবং যার প্রধান শিক্ষক ছিলেন রেডগে এবং তিনি একজন ইংরেজ ধর্ম যাজক।
১৫ শতকের দিকে ব্যবসাসহ বিভিন্ন কারণে উপমহাদেশে আসে ইংরেজরা
পরবর্তীতে ১৮৪১ সালে একই স্কুল প্রাঙ্গণে ভিত্তি স্থাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী বর্তমান ঢাকা কলেজের। উপমহাদেশের বিচারে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আরও বেশকিছু স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ বিচারে উচ্চ মাধ্যমিক তথা কলেজ শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় পাকিস্তান আমলে নটর ডেম কলেজ, ঢাকা; হলিক্রস কলেজ; সেইন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়; সেইন্ট গ্রেগরীজ স্কুল (পরবর্তীতে ২০১৬ সালে কলেজ শাখা) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হচ্ছে সাফল্যের সাথে। মূলত হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারদের মাধ্যমে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে সকল ধর্মের ছেলে-মেয়েদের। উচ্চ মাধ্যমিকে নটর ডেম কলেজ, ঢাকা; ছেলেদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ, যা ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত। এছাড়াও ঢাকার তেজগাঁওয়ে মেয়েদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে হলিক্রস কলেজ। সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ঢাকার মোহাম্মদপুরে ও পুরান ঢাকার বকশি্ বাজারে খ্রিষ্টান মিশনারি কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে আরেক শিক্ষার্থী সেইন্ট গ্রেগরীজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
রাজধানী ঢাকায় প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই; ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষালয়টি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম সরকারি স্কুল। ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ মূলত একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্যক্রম শুরু করেছিল।
বাংলাদেশের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় বরাবরই ইতিবাচক ফলাফল করছে ব্যাপিস্ট্যান্ট ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মাধ্যমে পরিচালিত এসব কলেজ। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, বিভিন্ন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা ও প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষায় দেশে এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য রয়েছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে যে-সব কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তার মধ্যে হলিক্রস, সেইন্ট জোসেফ, সেইন্ট গ্রেগরীজের মতো প্রতিষ্ঠানের সাফল্যই অন্যতম।
বর্তমানে বাংলাদেশে খ্রিষ্টান মিশনারির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এক হাজার ৫০০ এরও অধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষালয়ের মধ্যে এক হাজার ২০০ কিন্ডারগার্টেন, ২০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, ১৫টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দুটি ডিগ্রি কলেজ এবং একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষালয়ে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে সব ধর্মের ছেলেমেয়েদের। তবে খ্রিষ্টান ছেলেমেয়েদের বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং তাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় বিশেষ কোটাও। সাধারণত দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি নীতিমালার মাধ্যমে পরিচালিত হলেও ভর্তিসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিশনভিত্তিক এসব প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করে নিজস্ব নীতিমালা ও পদ্ধতি।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
খ্রিষ্টান মিশনারি তথা হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজকদের দ্বারা পরিচালিত অন্যতম বিদ্যাপীঠ সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্বে ‘সেইন্ট জোসেফ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’ নামে পরিচিত ছিল। আমেরিকান খ্রিষ্টান ধর্মযাজকরা এটি প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ক্যাম্পাস ছিল পুরান ঢাকার নারিন্দায়, পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে ঢাকার আসাদ এভিনিউয়ে স্থানান্তর করা হয় নতুন শিক্ষা কাঠামো।
বর্তমানে এখানে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় পাঠদান করা হয়। শুরুতে ইংরেজি মাধ্যম থাকলেও পরবর্তীতে বাংলা এবং আবারও ১৯৯৯ সালে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এখানে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই পাঠদান করা হয় এই শিক্ষালয়ে। বর্তমানে বছরান্তে সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শাখা থেকে ১৬৫ জন ও কলেজ থেকে ৬৫০-৭৫০ জন শিক্ষার্থী তাদের স্তরভিত্তিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সুযোগ রয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, হ্যান্ডবল, টেবিল টেনিস ও দাবার মতো বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার। এখানকার কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দাবার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, বাংলাদেশের দাবার দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান, দাবার তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার, গায়ক, গীতিকার ও সুরকার তাহসান রহমান খান, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় শাহরিয়ার নাফীস, সাবেক সাংসদ আন্দালিব রহমান, অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী অরুণ সাহা, রাজনীতিবিদ তারেক রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অভিনেতা ও কমেডিয়ান নাভিদ মাহমুদের মতো তারকারা।
সেইন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ ড. ব্রাদার জেমস পিরাইরা মনে করেন শিক্ষার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতি, যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের কারণে এখানকার শিক্ষার্থীরা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে। তিনি বলেন, আমরা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই। সেজন্য আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে শিক্ষার মানসম্মত ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে আমরা কাজ করছি। এখানে আমাদের লুকানো অথবা একদমই ভিন্ন কোনো কিছু নেই; আমরা শিখন-শিখানোর মাধ্যমে শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।
সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ অন্যতম আরেকটি ক্যাথলিক উচ্চ বিদ্যালয়। বাংলাদেশ পূর্ববর্তী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে বেলজিয়ামের বেনেডিক্টাইন ধর্মযাজক গ্রেগরি ডি গ্রুট এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষালয়েই জন্ম হয়েছিল ঢাকার নটর ডেম কলেজের এবং পরবর্তীতে নটর ডেম কলেজ মতিঝিলে স্থানান্তরিত হয় ১৯৫৩ সালে।
সেইন্ট গ্রেগরীতে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের একসাথে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল ১৯১২ সালে সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত। পরবর্তীতে এটি বয়েজ স্কুলে পরিণত হয় এবং ১৯১৪ সালের দিকে এখানেই সূচনা হয় বাংলাদেশ স্কাউটসের। দেশ বিভাগের আগে শুধু ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা হতো সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শিক্ষালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীদের তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংবিধান প্রণেতা ও আইনজীবী ডা. কামাল হোসেন, জামিলুদ্দিন হাসানদের মত গুণীজনেরা।
এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান শুরু করে শিক্ষালয়টি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের দিকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পর বিগত ২০০৮ সালে আবার ইংরেজি ভার্সনে পাঠদান চালু করা হয় সেইন্ট গ্রেগরীতে। পরবর্তীতে স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করা হয় ২০১৬ সালের দিকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ শিক্ষালয়টির প্রাঙ্গণ থেকে ছাত্র, শিক্ষকসহ মোট ৩০ জনকে জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। এদিন শিক্ষক পি ডি কস্তাসহ একাধিক শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাঁদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা অর্পণ করে সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
সেইন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শিক্ষালয়ের কৃতী শিক্ষার্থীদের তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী ভারতীয় বাঙালি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন, সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সংবিধান প্রণেতা ও আইনজীবী ডা. কামাল হোসেন, জামিলুদ্দিন হাসানদের মত গুণীজনরা।
এছাড়াও এ শিক্ষালয়েরই ছাত্র ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা তাজউদ্দিন আহমদ,বিখ্যাত ব্যান্ড শিরোনামহীনের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জিয়া। দেশের দুই গুণী ব্যক্তিত্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫০ সালে এবং জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৫৭ সালে এখান থেকে পাস করেন। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। আর একাধারে লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপকও নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক।
সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গ্রিন হ্যারাল্ড ইন্টান্যাশনাল স্কুল
নামকরা মিশনারি শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গ্রিন হ্যারাল্ড ইন্টান্যাশনাল স্কুলটি ক্যাথলিক আর্কডিওসেসের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষালয়টির অবস্থান মোহাম্মদপুরে সেইন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সন্নিকটেই। ক্যাথলিক স্কুল হলেও এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
১৯১২ সালের দিকে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে লেডি অব ক্রিশ্চিয়ান মিশনের এক ধর্মসভা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাজ্যের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সিলেবাসের আলোকে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি একই সাথে স্থানান্তরিত, সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট কর্তৃক নিবন্ধনকৃত ধর্মসভা কর্তৃক মালিকানাভুক্ত ও পরিচালিত হতে থাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সাল থেকে।
শিক্ষালয়টিতে মানবিক, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান বিভাগের অধীনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার পাশাপাশি এখানকার শিক্ষার্থীরা সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিতর্ক, হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখা কিংবা আর্ট প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায়। এছাড়াও বিদ্যালয়টিতে ফুটবল, ভলিবল এবং বাস্কেটবল টিম অংশগ্রহণের সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি এখানকার শিক্ষার্থীদের পঞ্চম গ্রেড থেকে বাধ্যতামূলকভাবে শিখতে হয় ফ্রেঞ্চ ভাষা।
সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স গ্রিন হ্যারাল্ড ইন্টান্যাশনাল স্কুলের কৃতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাপরিচালক আইরিন খান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা গীতিয়ারা সোফিয়ারা থাকবেন সামনের সারিতে। এছাড়াও দেশ ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন শিক্ষালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীরা।
হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
দেশের নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজধানীর হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় হলিক্রস কলেজের পাশেই অবস্থিত। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষাক্রম চালু রয়েছে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য নিয়ে তিন বিভাগেই। বর্তমানে শিক্ষালয়টির দুইটি শিফটে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮০০ জন।
ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ অংশে হলিক্রস সিস্টারদের আগমন ঘটে ১৮৫৩ সালে। এরপর বর্তমান ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মাত্র ২ জন ছাত্রী নিয়ে একটি কিন্ডারগার্টেন খোলা হয় ১৯৫১ সালের দিকে। শিক্ষালয়টি খোলার কৃতিত্ব ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের অধিভুক্ত মারী, ফ্রান্সলিয়া ও রোজ বার্নার্ড নামের তিনজনের। পরবর্তীতে একই বছরের নভেম্বরে শিক্ষালয়টি কিন্ডারগার্টেন থেকে রূপ নেয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
শুরুর দিকে বাংলা পড়ানো হলেও শিক্ষালয়টির প্রাধান্য ছিল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাধারায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছর পর ১৯৭২ সালের দিকে পুরোদমে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান শুরু হয় হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। এর আগে ১৯৬৩ সালের দিকে শিক্ষালয়টিতে নবম শ্রেণিতে মানবিক শিক্ষা শাখা এবং ১৯৭০ সালে চালু করা করা হয় মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষা। সবশেষ শিক্ষালয়টিতে বাণিজ্য বিভাগ চালু করা হয় ১৯৯৮ সাল থেকে। তবে এটি শুধুমাত্র নারী শিক্ষালয় হলেও শুরুতে এখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল ছাত্রদেরও; পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের দিকে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে এটিকে সম্পূর্ণ বালিকা বিদ্যালয়ে পরিণত করে কর্তৃপক্ষ।
হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ। বিতর্ক, আবৃত্তি, কুইজ, অঙ্কন, বিজ্ঞান ও ইংলিশ ক্লাবের মতো সহশিক্ষা কাঠামোয় সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব গুণাবলিসম্পন্ন হওয়ার। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস আবহের যাপিত গল্প তুলে ধরে ‘মন্দিরা’ নামক বার্ষিক প্রকাশনা। এছাড়াও এখানকার সকল শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে একজন নারী শ্রমিককে শিক্ষিত করার কাজে নিয়োজিত হতে হয়। আর এ কাজটি তত্ত্বাবধান করছে কারিতাস বাংলাদেশ। এছাড়াও ‘হলিক্রস লিটারারী প্রোগ্রাম’এর আওতায় ১৯৭২ সাল থেকে বিনামূল্যে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পান ৩০০ ছাত্রছাত্রী।
সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘ পরিচালিত আরেকটি শিক্ষালয় সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বাংলা মাধ্যমে পরিচালিত এ শিক্ষালয়টি পুরানো ঢাকা লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত। রোমান ক্যাথলিক ধর্মীয় আদেশে স্কুলটি পরিচালনা করছেন ক্রশ ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের নারী সদস্যরা। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি মাধ্যমের পাঠদান করা হলেও এখানে বাংলা মাধ্যমে পাঠদান শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালের দিকে।
সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কলেজ শাখার অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের দিকে। মিশনারি শিক্ষালয় হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে জাতি-ধর্ম ভেদে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরই।
Source: The daily campus