বিপন্ন শরণার্থী জীবনের ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্যেই উদযাপিত হচ্ছে এবারের বড়দিন। মার্কিন চার্চগুলো তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবারের বড়দিন উপলক্ষ্যে এক শরণার্থী শিশুর গল্প শোনাবে তারা। বিভিন্ন মার্কিন সংবাদমাধ্যম খবরটি নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু যে শরণার্থী শিশুর গল্প শোনানো হবে, সে আসলে কে? ইউএসএটুডের খবরে বলা হয়েছে, জেরুজালেমের ছোট্ট শহরতলী বেথলহামে জন্ম নেয় সেই শিশু। স্বৈরাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচতে রাতের আঁধারে মায়ের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়ে সেই শিশু। সেখানকার রাজা হেরোদের ভয়ে তারা পালিয়ে যান মিসরে। এই মা-ই হলেন মাতা মেরি, আর শিশুটি যিশু। যিশু একজন শরণার্থী শিশু ছিলেন বলেই তার গল্প শোনানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন চার্চগুলো।
উল্লেখ্য, বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, রাজা হেরোদের শাসনে অতিষ্ট জুডিয়ার সাধারণ মানুষ ভাবতেন এমন এক মসিহা আসবেন, যিনি তাদের রাজ্যে সুবিচার আর পবিত্রতা কায়েম করবেন, পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করবেন আর সমস্ত পৃথিবীকে এক এবং অদ্বিতীয় বিধাতার বিশ্বাসে ফিরিয়ে আনবেন।
হেরোড প্রথমে তা আমলে নেননি। পরে এই শিশুকে হত্যা করার আদেশ দেন। আদেশ দেওয়া হয়, ওই স্থানে দুই বছর বা এর কম বয়সী সব শিশুকে হত্যা করার। কিন্তু শিশু যিশুকে ততক্ষণে মিসরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
বাইবেলের গসপেল ম্যাথিউ-এর দ্বিতীয় পর্বে বর্ণিত আছে, একটি শিশুর জন্ম হলো যার নাম যিশু (গ্রিক ভাষায় যশোয়া)। তার জন্ম হলো হেরোডের রাজ্যের শেষ প্রান্ত, বেথেলহামে। যিশুর জন্মগ্রহণ উপলক্ষেই প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন বা ক্রিসমাস পালন করা হয়।
যিশুর শরণার্থী জীবনের কথা সামনে এনে শরণার্থী শিশুদের প্রতি মানুষের আবেগ জাগাতে চেষ্টা করবে মার্কিন চার্চগুলো।
এই বিবরণ চলতি বছরের আগস্টে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রক্তাক্ত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে বসা আলেপ্পোর সেই ছোট্ট শিশু ওমরান দাকনিশের কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর বিমান হামলায় আহত হয় ওমরান।
ওয়ার্ল্ড রিলিফ-এর পরিচালক ম্যাথিউ সোয়েরেনস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি হয়ত পুরো গল্পটির অংশবিশেষ, যা আমরা সেভাবে আমলে নিই না। আমরা গল্পটির ইতি টানতে চাই যেখানে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ যিশুর পাশে বসে আছেন। এরপর সবাই ঘরে গিয়ে বড়দিনের ডিনার করবেন। কিন্তু শাস্ত্রমতে, গল্পটি সেখানে শেষ হয় না।’
ওয়ার্ল্ড রিলিফ সেই নয়টি বেসরকারি সংস্থার একটি, যারা মার্কিন সরকারকে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সহযোগিতার জন্য কাজ করে আসছে। সোয়েরেনস জানান, তারা গত বছর থেকে শরণার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য চার্চের মধ্যে কাজ করছেন। তারা আশা করছেন, এই গল্প বলার মধ্য দিয়ে আরও অনেক মানুষ শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসবেন।
এর আগে পোপ ফ্রান্সিস সেইন্ট পিটারস স্কয়ারে দেওয়া ভাষণে শরণার্থীদের সঙ্গে শিশু যিশুর জন্মের সময়কালের সাদৃশ্য বর্ণনা করেছিলেন।
সোয়েরেনস বলেন, দেশজুড়ে যেসব চার্চের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড রিলিফের সম্পর্ক রয়েছে, সেখানেই এই গল্প শোনানোর আয়োজন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি কোনও মজার বিষয় নয়। বরং এটি পুরো গল্পটির অংশ। আর আমি মনে করি, বর্তমান বিশ্বে যা হচ্ছে, তা এখানে উঠে আসে, আর এজন্যই তা এতো গুরুত্বপূর্ণ।’
এ প্রসঙ্গে শিকাগোর পার্কভিউ কমিউনিটি চার্চের জ্যেষ্ঠ পাদ্রি রে কোলবোকার বলেন, ‘এর আগে আমি যিশুকে এভাবে ভাবতে পারিনি। আমি গল্পটা জানি, আমি তা পড়েছি, কিন্তু তার পরও আমি তা ভাবতে পারিনি।’
পার্কভিউ কমিউনিটি চার্চের এক বার্তায় বলা হয়, ‘আপনি কি জানেন, এক শরণার্থীর জন্যই আমরা বেঁচে আছি।’
টেম্পে শহরের রিডেম্পশন চার্চের পাদ্রি জিম মুলিনস যিশুর ঘটনার সঙ্গে তিন বছর বয়সী শিশু আলান কুর্দির সাদৃশ্য খুঁজে পান। আলানের পরিবার সিরিয়া থেকে সমুদ্রপথে পালিয়ে ইউরোপে আসার সময় নৌকাডুবিতে তার মৃত্যু হয়। তার মরদেহ ভেসে আসে ইউরোপে। গত দুই বছর ধরে রিডেম্পশন চার্চ শরণার্থীদের সাহায্যে কাজ করছে।
সোয়েরেনস জানান, চলতি বছরে বিশ্বজুড়ে মোট ২ কোটি ১৩ লাখ শরণার্থী পুনর্বাসিত হয়েছেন। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৮৫ হাজার মানুষের ঠাঁই হয়েছে। যা মোট শরণার্থী পুনর্বাসনের ০.৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে যেসব শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হয়েছে, তারা সিরিয়া থেকে আগত নন। এদের বেশিরভাগই কঙ্গো থেকে আসা। ওই শরণার্থীদের মধ্যে খ্রিস্টান ও মুসলিমের সংখ্যাও সমান। সোয়েরেনস বলেন, ‘মানুষ সবসময় পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হবেন, এমনটা নয়।’
পার্কভিউ চার্চের কোলবোকার বর্তমান পরিস্থিতি ও যিশুর অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য তুলে ধরে একে মানুষের সামনে প্রকাশ করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘এটি এক বিশাল সংকট। কিন্তু আমরা এতে অংশগ্রহণ করতে পারি।’