নিউজ ডেস্ক।।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের নীতিমালাকে সামনে রেখে স্থায়ী ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হচ্ছে। লন্ডন ইন্টার ব্যাংক রেট বা লাইবর রেটের সাথে ব্যাংকনির্ধারিত সুদ যোগ করে মোট সুদহার নির্ধারণ কর হয়। ঠিক সেভাবে স্থানীয় পাঁচ ধরনের বন্ডের সুদের গড় হারের সাথে একটি রেট নির্ধারণ করে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেই হার চার থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে রাখার বিষয়ে বিবেচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে এক লাফে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এ দিকে ইচ্ছাকৃতই হোক আর ব্যবসায় মন্দার কারণে বেকায়দায় পড়ে হোক রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) যারা ব্যবহার করে সময়মতো পরিশোধ করবেন না তাদেরকে নিয়মিত সুদহারের সাথে বাড়তি ৪ শতাংশ দণ্ড সুদ গুনতে হবে।
ইডিএফের চলমান সুদহার রয়েছে ৪ শতাংশ। কেউ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে চার শতাংশের সাথে বাড়তি চার শতাংশ মিলে ৮ শতাংশ সুদ গুনতে হবে। এমন নির্দেশনা দিয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। তখন থেকেই ব্যাংকগুলোর মুনাফা ধরে রাখতে আমানতের সুদহারও ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ আর ব্যাংকে নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছেন না।
বরং ব্যাংকে যারা আমানত রেখেছিল তাদের অনেকেই অভাবের তাড়নায় ভেঙে ফেলছেন। এর ফলে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমে গেছে। অপর দিকে বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকা গত এক বছরে অবমূল্যায়িত হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
আবার তহবিল সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয়ও বেড়ে গেছে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানোর জন্য একদিকে যেমন ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবদার করে আসছে, তেমনি অর্থনীতিবিদরাও এর যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। অপর দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ব্যাংকঋণের সুদহারের একক হার তুলে দিতে বলা হয়েছে। সবমিলেই ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা।
কিন্তু এই সুদহার কিভাবে বাড়ানো হবে তা নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করা হচ্ছে দীর্ঘ প্রায় দুই মাস ধরে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত আগামী জুন মাসের মুদ্রানীতি প্রণয়নের বৈঠকে এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠক সূত্র এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যানুযায়ী, এখন দুই বছর মেয়াদি বন্ডে সুদের হার ছিল ৭.৫৫, পাঁচ বছর মেয়াদি ৭.৯০, দশ বছর মেয়াদি ৮.৩৩, ১৫ বছর মেয়াদি ৮.৭৭ এবং ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ছিল ৮.৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই পাঁচ ধরনের বন্ডের সুদহারের গড় ৮.৩০ শতাংশ।
এই রেটের সাথে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ শতাংশ করিডোর রেট নির্ধারণ করে দেয় তাহলে ১৩.৩০ শতাংশে ঋণ বিতরণের সুযোগ পাবে ব্যাংক। অর্থাৎ এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে এক লাফে চার শতংশ বৃদ্ধি পাবে ব্যাংকঋণের সর্বনিম্ন সুদহার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করতেই এই সিদ্ধান্তের কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বৈঠক সূত্রে আরো জানা যায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য জুনের তৃতীয় সপ্তাহ নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের মুদ্রানীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ শুরু করেছে। নতুন মুদ্রানীতিতে পলিসি রেট ও ঋণের সুদহার নির্ধারণের বিষয়ে কাজ চলছে। ব্যাংকঋণের সুদহারের ক্ষেত্রে রেফারেন্স রেট ও করিডোর রেট নিয়ে প্রাথমিকভাবে চিন্তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রেফারেন্স রেট হবে মূলত বন্ডের সুদহারের গড় সুদহার। আর করিডোর রেট বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দেয়ার কথা রয়েছে। দুটোর যোগ করে যে রেট হবে সেটাই হবে ব্যাংকঋণের সুদহার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জুনের তৃতীয় সপ্তাহে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। চলমান মুদ্রানীতির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও আগামী মুদ্রানীতি কী কী থাকবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে আজকের বৈঠকে।
তিনি আরো বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ঋণের সুদহার কী করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এখানে ব্যান্ডিং ও রেফারেন্সের রেটের কথা ভাবা হচ্ছে। এসব বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আগামী মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে বিস্তারিত ঘোষণা করা হবে।
এর আগে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে আন্তর্জাতিক বিজনেস সামিটে ব্যাংকঋণের সুদহারে পরিবর্তন আসছে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসিগত কাজ করছে।
চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছি। একাধিক হারও বাদ দেবো। বিনিময় হার হবে বাজারভিত্তিকও এক। আমরা এর কাছাকাছি। শিগগির একটি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা দেখতে পাবেন।
আর সুদের হার নিয়েও কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে আমানতের সুদের হারের ফ্লোর ও সিলিং প্রত্যাহার করেছি। বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ করে করিডোর প্রথা চালু করা হবে। শিগগির আমরা এ নতুন উদ্যোগ চালু করতে সক্ষম হবো।