ডেস্ক: ঢাকা: বেসরকারি কলেজ সরকারি করার পর, সেখানকার শিক্ষকরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হবেন কিনা, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আসা সদস্যরা এর বিরুদ্ধে। তবে বেসরকারি শিক্ষকদের মতে, এটা হীনমন্যতা।
বাংলাদেশে ২৮৩টি বেসরকারি কলেজকে সরকারি (জাতীয়করণ) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত এপ্রিল মাসে। এর আগেও ধাপে ধাপে কিছু বেসরকারি কলেজকে সরকারি করা হয়েছে। এত বেশি সংখ্যক কলেজ একসঙ্গে সরকারি করার সিদ্ধান্ত এই প্রথম। এছাড়া এ পর্যন্ত ৫৩টি কলেজ সরকারি করার চূড়ান্ত আদেশ জারি হয়েছে।
সেখানকার শিক্ষকরাও ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোর ব্যাপারেও আদেশ জারি হবে। আর এতেই আপত্তি সরকারি কলেজে কর্মরত বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকদের। তাদের কথা, ‘বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি করা হোক। সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। তবে তারা বিসিএস পরীক্ষা না দিয়েই বিসিএস ক্যাডারভুক্ত হবেন, এটা আমরা মানতে পারি না।’
দেশে বর্তমানে ১৫ হাজারের বেশি ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এবং দু’হাজার এর আগে বিভিন্ন সময় জাতীয়করণকৃত কলেজের আত্মীকৃত শিক্ষক।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার এবার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মোট ২৮৩টি কলেজ জাতীয়করণ করছে। এতে করে ১৫-১৬ হাজার বেসরকারি শিক্ষক সরকারি হবেন। তাদের যদি ক্যাডারভুক্ত করা হয়, তাহলে আমরা যারা প্রকৃতই বিসিএস ক্যাডার, তারা কোণঠাসা হয়ে পড়বো, মাইনরিটি হয়ে পড়বো।
আমাদের পদ, পদোন্নতি, সিনিয়রিটি এ সব বিষয় নিয়ে আমরা জটিলতায় পড়বো। এই জটিলতায় মামলা-পাল্টা মামলা হবে। এটা ন্যায়নীতি বিরোধী। কারণ আমরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হয়েছি।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নতুন যেসব কলেজ সরকারি হবে তার শিক্ষকরা ঐ কলেজেই থাকবেন। বদলি হবেন না। প্রধানমন্ত্রীর এই কথাতেই ইঙ্গিত আছে যে, তারা বিসিএস ক্যাডার হবেন না। ক্যাডার হলে তো বদলির বিষয় থাকত। তাছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষা নীতিতেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সিনিয়রিটি ও তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বলা হয়েছে।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা এ মাসে দু’দিন ( ২৬ ও ২৭ নভেম্বর) কর্মবিরতি পালন করেছি। ডিসেম্বর মাস যেহেতু বিজয়ের মাস, তাই ঐ মাসে কোনো কর্মসূচি দেইনি। জানুয়ারি মাসের ৬, ৭ ও ৮ তারিখে ফের কর্মবিরতিতে যাব। তাতেও যদি আমাদের দাবি আদায় না হয়, তাহলে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচি দেবো।’
তার কথায়, ‘কলেজ জাতীয়করণ হোক তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তাদের বেতন-ভাতাসহ আমাদের মতো অন্যান্য সুবিধা দিলেও আপত্তি নেই। আমাদের দাবি, ঐ সব শিক্ষককে নন-ক্যাডার মর্যাদায় রাখতে হবে। তাদের বদলি করা যাবে না এবং পদোন্নতির পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য আলাদা একটি বিধিমালা জারি করতে হবে।’
অন্যদিকে জাতীয়করণের আওতাভুক্ত শিক্ষকরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাদের ক্যাডারভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। কলেজ জাতীয়করণের আদেশ ২০০০-এ এ কথা উল্লেখ আছে। তাই তারা মনে করেন, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে না এলেও বিসিএস ক্যাডারদের চেয়ে তাদের অভিজ্ঞতা কম নয়।
জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে মাত্র তিনটি কলেজ সরকারি ছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে কলেজ জাতীয়করণ হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০০টি কলেজ সরকারি হয়েছে। ঐ সব কলেজের শিক্ষকরা ক্যাডার হিসেবেই নিয়োগ পেয়ে আসছেন। তবে এখন এটা নিয়ে কথা উঠছে কেন? যারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি কলেজ স্থাপনের বিরোধী, তারাই এখন এ সব কথা বলছেন।’
তিনি বলেন, ‘২০০০ বিধি অনুযায়ী, যেসব বেসরকারি কলেজ সরকারি কলেজ হিসেবে আত্মীকৃত হবে, সেসব কলেজের শিক্ষকরাও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে আত্মীকৃত হবে। সরকারের এবারের সিদ্ধান্তে বিসিএস শিক্ষায় নতুন ১৫ হাজার পদ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এদের এই বিরোধিতার কারণে নতুন পদ সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ১৫ হাজার শিক্ষকের বড় একটি অংশ ৫-৬ বছরের মধ্যে অবসরে চলে যাবেন। তখন নতুনদের জন্য বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা সরকারি কলেজের শিক্ষক হলে তাদের নন ক্যাডার করার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, শিক্ষা ক্যাডারের অধিকার সংরক্ষণের কথা। তাদের কোনো অধিকার কেটে তো আমাদের দেয়া হবে না। আমাদের যা দেবে সরকার দেবে, রাষ্ট্র দেবে। তাতে তাদের আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যদি নন ক্যাডার করা হয় তাহলে তা হবে বৈষম্যমূলক।একই কলেজে একই সিলেবাসে পড়াবেন আর দু’জন শিক্ষকের মর্যাদার বৈষম্য হবে, এটা তো হয় না।’
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওয়াহিদুজ্জামান এ নিয়ে ডয়চে ভেলের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’
এদিকে এই সঙ্কট নিয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য এখনো দেয়নি। তবে গত রবিবার এ নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।
প্রসঙ্গত, এখন সরকারি কলেজ ৩১৫টি। আর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরো ২৮৩টি কলেজ সরকারি হলে মোট সরকারি কলেজ হবে ৫৯৮টি।