রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে লাগা আগুনে এখন পর্যন্ত ৪৬ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং পরিচয় শনাক্ত হয়েছে ২৭ জনের। শুক্রবার (১ মার্চ) সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে এসব মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে ১৫ জনই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।
মায়ের সাথে কাচ্চি খেতে গিয়ে লাশ
রাজধানীর বেইলি রোডে ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় মায়ের সঙ্গে প্রাণ হারান জান্নাতিন তাজরিন (২৩)। তিনি বেসরকারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় তার সঙ্গে নিহত হয়েছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক লুৎফুন নাহার করিম (৪৭)। তারা চিকিৎসকের কাছ থেকে ফেরার পথে কাচ্চি খেতে গিয়েছিলেন এবং ভবনে আগুন লাগতে তাতে পুড়ে মারা যান।
রয়েছেন বুয়েটের দুই শিক্ষার্থীও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন ও লামিশা ইসলাম। নাহিয়ান আমিন উচ্চশিক্ষালয়টির ইইই বিভাগের ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী। আর লামিসা ইসলাম একই ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী।
পুড়ে মারা গেলেন ড্যাফোডিলের তুষারও
এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তুষার হাওলাদার। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংবাদিকতা বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি ঝালকাঠি জেলায়। জানা গেছে, তুষার স্টার টেক নামে একটি আইটি কোম্পানিতে ভিডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভে মাল্টিমিডিয়ায় কাজ করতেন।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন নুসরাত ও তার খালাতো বোনেরা
রাজধানীর সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান, তার খালাতে বোন মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়া খাতুন ও তার বোন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন আলেশা (১৪)। তারা একটি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বেইলি রোডের ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন, এরপর সেখানে আগুন লাগলে তারাও দগ্ব হয়ে মারা যান।
বোনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন প্রিয়ন্তী
কানাডা থেকে ফেরা বোনের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা গিয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের কলেজছাত্রী জারিন তাসনীম খান প্রিয়ন্তী। বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে তিনিও ফিরছেন লাশ হয়ে। মুন্সীগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজের ইংরেজি সম্মান শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন তিনি।
চাকরির তিন বছর পূর্তিতে ট্রিট, বোনসহ না ফেরার দেশে দোলা
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী মেহরান কবির দোলা এবং একই উচ্চশিক্ষালয়ে পড়ুয়া তার ছোট বোন মাইশা কবির মাহিও রয়েছেন নিহতদের তালিকায়। দোলা বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তার কর্মজীবনের তিন বছর পূর্তিতে ছোট বোনকে ‘ট্রিট’ দিতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটির একটি রেস্টুরেন্ট গিয়েছিলেন এবং এ ঘটনায় তারাও নিহত হয়েছেন।
রয়েছেন আরও যেসব শিক্ষার্থী
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির অর্থ জোগাড় করতে আসা শিক্ষার্থী নাঈম আহমেদও রয়েছেন নিহতদের তালিকায়। এছাড়া ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও তরুণ সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীও নিহত হয়েছেন গতরাতের অগ্নিকাণ্ডে। একই সাথে নিহতদের তালিকায় রয়েছেন একই সাথে এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম (২২)।
আর আগুনে পুড়ে নিহতদের মধ্যে থাকাদের আরেকজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সাবেক এক শিক্ষার্থী মো. নুরুল ইসলাম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সান্ধ্যকালীন এমবিএ ১৩ ব্যাচের (২০১৮ সেশনের) শিক্ষার্থী ছিলেন।
গতরাতের এ ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। তার পড়াশোনা করছেন বা সদ্য শিক্ষা জীবনের পাঠ চুকিয়ে প্রবেশ করেছেন কর্মজীবনে। নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যে ২৭ জনের পরিচয় মিলেছে তাদের মধ্যে আরও শিক্ষার্থী থাকতে পারেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২৭ জনের পরিচয় শনাক্ত, ৩৫ মরদেহ হস্তান্তর
ঢামেকের সামনে থাকা ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, সকাল ১০টা পর্যন্ত ৩৫টি মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিহত ২৭ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম এ নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত বহুতল ভবনে আগুন লাগে। এতে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে—সেটি সাততলা। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও ছিল খাবারের দোকান। ওই ভবনটিতে পিৎজা ইন, স্ট্রিট ওভেন, খানাসসহ আরও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এছাড়া ইলিয়েন, ক্লোজেস্ট ক্লাউডসহ জনপ্রিয় বিপণিবিতানও ছিল একই ভবনে।
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬
গতকাল রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. সামন্ত লাল সেন। এ ঘটনায় দগ্ধ চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরাও শঙ্কামুক্ত নন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
শঙ্কামুক্ত নন দগ্ধরা
এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরিস্থিতি ভয়াবহ: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
পরিস্থিতিকে ভয়াবহ উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘যারা এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন, তাদের বেশিরভাগের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সবাইকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
পুড়ে নয়, বেশি মৃত্যু বিষক্রিয়ায়
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ ধারনা করছেন, যারা মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগেরই ‘এক্সটার্নাল বার্ন’ কম ছিল। এ অবস্থায় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় আহত ও মৃতদের ‘ইন্টার্নাল বার্ন’ হয়েছে। আহত সকলের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে এবং ইন্টার্নাল বার্ন হয়েছে। এই মুহূর্তে সবার অক্সিজেন সেচুরেশন ভালো রয়েছে। তবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পার না হলে বোঝা যাবে না। তারা প্রত্যেকে কার্বন মনোক্সাইড ইনফেল করেছেন। এটি মারাত্মক বিষাক্ত। এটি ইন্টার্নাল অর্গানগুলোকে নষ্ট করে দেয়। অক্সিজেন গ্রহণে বাধা প্রদান করে। ফলে যতক্ষণ না এই গ্যাস বের হচ্ছে রোগীরা শঙ্কামুক্ত নন।
ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, আমাদের যে ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয় তাতে হাইড্রো কার্বন থাকে। এছাড়া মিথেন গ্যাস পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড ও ডাই অক্সাইড তৈরি হয়। হাইড্রো কার্বন থেকে ডাই ও মনোঅক্সাইড তৈরি হয়। এটি মারাত্মক বিষাক্ত, এমনকি তৎক্ষণাৎ মৃত্যুও হতে পারে। আমরা ধারণা করছি, কার্বন মনোক্সাইডের কারণেই এত অধিক মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও একই দাবি করা হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকেও। শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে যাওয়ার পর সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন। তিনি বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই আগুনে পুড়ে নয়, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ওই ভবনে একটাই মাত্র সিঁড়ি ছিল ও দুটো লিফট ছিল। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে লিফট বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণে লোকজন নামতে পারেনি।