বিসিএস খুবই রিস্কি গেম, সঙ্গে প্ল্যান বি রেডি রাখতে হবে

Image

নিজস্ব প্রতিবেদক,৩ মে ২০২২ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নুসরাত নওশীন। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসারের (এমটিও) চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ৪০তম বিসিএসের প্রস্তুতি।

সম্প্রতি এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এতে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি, তার মেধাক্রম-৬৪। শিক্ষাবার্তার নিকট নিজের বিসিএস জয়ের গল্প শুনিয়েছেন নুসরাত নওশীন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডাঃ এস কে দাস।

ডাঃ দাস : বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন কবে থেকে দেখছেন?

নুসরাত নওশীন: আমি আমার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মা ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা, বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা। দুজনেই বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। একমাত্র সন্তান হওয়াতে তাদের সমস্ত স্বপ্ন আমাকে ঘিরেই ছিল। ঢাকার এ কে হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ৫৫তম স্থান লাভ করে নিজ পছন্দে ভর্তি হই অর্থনীতি বিভাগে।
অর্থনীতি এমন একটা বিষয় যেখানে উচ্চতর শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া, বিদেশে সেটেল হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা কখনো হয়নি, কারণ আম্মু আব্বুকে একা রেখে বিদেশে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই শুরু থেকেই দেশের মধ্যে ক্যারিয়ার গুছানোর প্ল্যান ছিল আমার। আর এজন্য দেশের ভিতরে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ মর্যাদার চাকরি যেটা, অর্থাৎ বিসিএস, সেটাকেই টার্গেট করেছি। বিসিএস এর টার্গেট অনেক আগে থেকে থাকলেও আমি মূলত প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি মাস্টার্স পরীক্ষার পরে।

ডাঃ দাস: কখন থেকে বিসিএস প্রস্তুতি নেয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

নুসরাত নওশীন: বর্তমানে একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করে দেয়া। আমি বলবো, যাদের টার্গেট বিসিএস তারা চাইলে তৃতীয় বর্ষ থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে বিসিএস এর পড়া পড়তে গিয়ে একাডেমিক রেজাল্ট যেন কোনক্রমেই খারাপ না হয়। যেন বিসিএস হাত ফসকে গেলেও ভালো একাডেমিক রেজাল্ট দিয়ে আপনি অল্টারনেটিভ ক্যারিয়ার অপশনটি বেঁছে নিতে পারেন।

ডাঃ দাস : স্বপ্ন পূরণের প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন, এই ক্ষেত্রে পড়াশোনার রুটিন কেমন ছিলো?

নুসরাত নওশীন: আমার প্রস্তুতি একদমই নিজের মত গোছানো ছিল। আমি কোথাও কোচিং করিনি, মডেল টেস্টও দেইনি। নিজেই সিলেবাস এনালাইসিস করে টপিক ধরে ধরে পড়েছি। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম বিধায় গণিত আর বিজ্ঞানে ভালোই দখল ছিল। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই বাংলা আর ইংরেজিতে ছিল আমার শিক্ষক মায়ের দেয়া শক্ত হাতেখড়ি। অন্যান্য বিষয়গুলোও নিজের মত গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছি।

আমার পড়াশোনার রুটিন টাইম ওরিয়েন্টেড ছিল না, টার্গেট ওরিয়েন্টেড ছিল। অর্থাৎ আমি প্রতিদিন কয় ঘণ্টা পড়বো সেটা ঠিক করতাম না। কতটুকু পড়ে শেষ করবো, কোন সাবজেক্ট কবে শেষ করবো সেটা ঠিক করতাম। যেমন ধরলাম, আগামী দশ দিনে আমি বাংলা সাহিত্য শেষ করবো। তাহলে প্রতিদিন আমার কতটুকু পড়া লাগবে একটা টার্গেট ধরে সেইমত পড়তাম। প্রতিদিনের পড়ার টার্গেট শেষ করতাম, সেটা যতক্ষণই লাগুক না কেন।

ডাঃ দাস : এই সংগ্রামের পথে আপনার কোন স্মরণীয় কিংবা দুঃখের ঘটনা মনে পড়ে?

নুসরাত নওশীন: সংগ্রাম অনেক বড় একটা শব্দ। আমাকে বেশ কিছু ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আমি এটাকে সংগ্রাম বলবো না, একটা জার্নি বলবো। চার বছরের জার্নিতে অনেক স্মরণীয় ঘটনাই আছে। একটা ঘটনার কথা বলি।

আমার বাবা স্ট্রোক করে গত তিন বছর ধরে শয্যাশায়ী। আমার বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষার ফলাফল যেদিন দিল সেদিন, আমার ভাইভা যেদিন হয় তার আগের এক সপ্তাহ এবং আমার বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল যেদিন প্রকাশিত হয় সেদিন, কাকতালীয় ভাবে এই তিন সময়েই আব্বু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আর আমি যথারীতি আব্বুর পাশে হাসপাতালে ছিলাম। বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল যেদিন দেয় সেদিন আম্মুও সাথে ছিল না, টানা দশ দিন হাসপাতালে আব্বুর সাথে হাসপাতালে থেকে আর না ঘুমিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আম্মুকে সেদিন জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেই। যেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য এত প্রতীক্ষা, আম্মুকে আমার সেই রেজাল্টটা ফোনে জানাতে হয়। মেয়ের সাফল্যে আম্মুর তাতক্ষণিক হাসিমুখটা দেখতে কেমন হয়েছিল আমার আর কোনদিন জানা হবে না। আর যে আমার সামনে ছিল, অর্থাৎ আব্বু, সে তো কিছু বুঝেই না। আব্বুর সারাজীবনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তার মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে, অথচ তার কোন অভিব্যক্তি নেই। তার চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়েছিল কেবল, সেটা কেন তাও বুঝার উপায় নেই। নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছিল সেই মুহূর্তে। এই আফসোস কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব না।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।