প্রশ্নফাঁসে দায় কার?

নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও একাডেমিক সব পরীক্ষার আগেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন। এবার ফাঁস হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসে মূলত শিক্ষকরাই জড়িত।

আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। তবে যেখান থেকেই ফাঁস হোক জড়িতরা বরাবরই থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। একে অপরকে দোষ দেয়ার মাধ্যমেই দায় এড়াচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় সবার একটাই প্রশ্ন প্রশ্নফাঁসের শেষ কোথায়?

কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের খবর সংবাদ মাধ্যমে আসছে। তবে এবার এর ব্যাপকতা পৌঁছেছে প্রাথমিক স্তরেও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগের পরও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জেএসসি এবং পঞ্চমের পিইসিতে অনেক বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগেই চলে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

পিইসির শেষ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে একটি ফেসবুক পেজে।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন ফাঁস রোধে সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, প্রশ্নফাঁস রোধে একটি সমাধানের পথ আছে, কিন্তু এতে সমস্যাও আছে। পরীক্ষার প্রশ্ন আগে না ছাপিয়ে কেন্দ্রে ছাপানো হবে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে। সে কক্ষটিকে আমরা বলি স্ট্রং রুম। সে কক্ষে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না, আর কাউকে বাইরে যেতেও দেয়া হবে না। তারা কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে পারবে না।

কক্ষটি সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। কতক্ষণ আগে প্রশ্ন ছাপাতে হবে, এর জন্য কী কী লাগবে সে বিষয়গুলো পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে। কোনো ধরনের মোবাইল ফোন বা ডিভাইস রাখা যাবে না সে কক্ষে। রাখলেও তার মাধ্যমে যেন যোগাযোগ করা না যায়, সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে অনেকেই বলে থাকেন, এ প্রশ্নের আশপাশে যারা থাকেন অর্থাৎ শিক্ষকরাই এটি করে থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁস হলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বরাবরই এ অভিযাগ অস্বীকার করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল জোরেসোরেই। উপাচার্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর সিআইডি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি প্রেসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছিল। এই প্রেসে ছাপা হতো ভর্তির প্রশ্ন। এই প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২ থেকে ৭ লাখ টাকার লেনদেন হতো বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে দুইটি কোচিং সেন্টারেরও নাম এসেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নই নয়, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নও নিয়মিত ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠলে তা প্রতি বছরই ধামাচাপা দেয়া হয় বলে অভিভাবকদের দাবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে মেয়েকে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন নাটোরের রফিকুল হক। কিন্তু মেয়ে টেকেনি। তবে অন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ের ভর্তির সুযোগ হয়েছে। ক্ষুব্ধ রফিকুল হক বলেন, এভাবে চললে তো হবে না। মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে বলেছিল, ভর্তির সুযোগ পাবে। কিন্তু পরে দেখা গেল প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে তারাই তো এগিয়ে থাকবে? আমার মেয়েটা ভালো পরীক্ষা দিয়েও সুযোগ পেল না।

ফাঁস হচ্ছে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও। চলতি বছরের ৬ অক্টোবর সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার্থী আসমা আক্তার বলেন, পরীক্ষা দিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। আশা করেছিলাম টিকে যাব। কিন্তু রাতে একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। ভেবেছিলাম গুজব। কিন্তু পরদিন প্রায় সব জাতীয় পত্রিকায় যখন খবর বেরুল, তখন হতাশ হয়ে গেলাম। পরে অবশ্য পরীক্ষা বাতিল করে ফের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, অসংখ্য মানুষ যে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হলো তার কী হবে? তারা বলছেন, প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষার আগে-পরেই অভিযোগ ওঠে প্রশ্নফাঁসের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অভিযোগ আমলে না নিয়ে অস্বীকার করার মাধ্যমেই দায় শোধ দেয়।

শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দুষলেও দুদকের ‘শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের’ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্রও যুক্ত থাকতে পারেন বলে দুদকের তদন্তকারীদের ধারণা। প্রশ্ন ফাঁস, নোট-গাইড, কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি রুখতে ৩৯ দফা সুপারিশসহ ওই প্রতিবেদন ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, শিক্ষা সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।