স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশ্ন ফাঁস রোধে পাবলিক পরীক্ষার সময় প্রয়োজনে মোবাইল ফোন ও ফেসবুক বন্ধ করার কথা ভাবছে সরকার। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, পরীক্ষা চলাকালীন ফেসবুক ও মোবাইল বন্ধ রাখা যায় কিনা, এ বিষয়ে আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিজি প্রেসের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আগামী এসএসসি পরীক্ষায় কেউ যদি কেউ প্রশ্ন ফাঁসের চেষ্টা করেন, কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্ন আকারে সাজেশন দেয়া হয় কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার চেষ্টা করেন অর্থাৎ এবার যদি কেউ প্রশ্ন ফাঁসের পথে হাঁটেন তাহলে হাত ভেঙ্গে দেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আগামী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। সভায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন ও অর্থ) নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে র্যাব, ডিবি, এসবিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবকে (অধিশাখা-১০)। সভায় শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভাতেই মন্ত্রী ফেসবুক ও মোবাইল ফোন বন্ধের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের আইন খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। সভায় উপস্থিত বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক কাজী মাহমুদুর রহমানের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ফেসবুকে আনন্দ-ফুর্তি হয়, আর কী হয়। প্রয়োজনে পরীক্ষার সময় ফেসবুক বন্ধ রাখা যায় কিনা দেখুন। প্রয়োজনে পরীক্ষার সময় মোবাইল একদিন বন্ধ রাখুন। এ বিষয়ে আইন-কানুন দেখুন আপনারা। সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আগামী প্রজন্ম মোবাইল ফোনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে তা ঠিক নয়। প্রয়োজনে আইন দেখেনÑ প্রয়োজনে পরীক্ষার দিন মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেব। প্রয়োজনে ফেসবুকও বন্ধ করে দেব। এর আগে গত রবিবার থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বাংলা ও ইংরেজী পরীক্ষার আগে হুবহু প্রশ্ন পাওয়া যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সমালোচনা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ধরনের সংবাদকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে আর এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান কোন জেলাতেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাবি করে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে তার দায় তিনি নিজের কাঁধে নেবেন। মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর বলছে, শিশুদের এ পরীক্ষায় যে কোন শিক্ষক মডেল প্রশ্ন করলেও অধিকাংশ কমন পড়বে। সিলেবাস খুব ছোট হওয়ায় মডেল প্রশ্ন আকারে অসাধু চক্র ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক হতে হবে। এর আগে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সমাপনীতেও বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন আগেই ফেসবুকে প্রকাশের খবর পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, গেল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ও। উচ্চ মাধ্যমিকে অভিযোগের সত্যতা মেলায় ঢাকা বোর্ডের ইংরেজী দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা পিছিয়েও দেয়া হয়েছিল। এবার সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হলো।
প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিভ্রান্ত না হওয়ারও অনুরোধ জানিয়ে শিক্ষার্থীদের মন দিয়ে পড়ালেখা করার আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী। কোচিং সেন্টারগুলোর ওপর গত এক বছর ধরে নজরদারি করা হচ্ছে জানিয়ে নাহিদ বলেন, আজ থেকেই নতুন করে আরও বেশি নজরদারি করা হবে। পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টারের কোন ধরনের তৎপরতা বরদাশ্ত করা হবে না। প্রশ্ন ফাঁস করলে, প্রশ্ন ফাঁসের চেষ্টা করলে, প্রশ্ন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালেও কেউ রেহাই পাবে না। আগামী বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। এ জন্য বৃহস্পতিবার থেকেই প্রশ্ন মুদ্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ইংরেজী প্রশ্ন ফাঁসের পর প্রশ্ন ছাপানোর প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী। ‘সাজেশন’ আকারে ফেসবুকে প্রশ্ন তুলে দেয়াকে ‘বেআইনী’ আখ্যায়িত করে মন্ত্রী বলেন, ‘এদের’ বিরুদ্ধেও আইনীভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রশ্নপত্র বা সাজেশন সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক কারও কাছে পাওয়া গেলে বা ফেসবুকে দেয়া হলে প্রশ্নপত্র সম্পর্কিত আইন ১৯৮০ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষকে মামলা করার পরামর্শ দেন মন্ত্রী। বলেন, শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁসের প্রচারণা চালানো হয়। কেউ কেউ এসব প্রচারণাকে উৎসাহিত করেন। অভিভাবকদের বলি, আপনারা এসব প্রচারণায় কান দেবেন না। শিক্ষার্থীদের মন দিয়ে লেখাপড়া করারও আহ্বান জানান মন্ত্রী। কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা যায় কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রাতারাতি তা বন্ধ করা যায় না। এটা বন্ধ করতে গেলে সমস্যা আছে। তবে কেউ প্রশ্ন ফাঁস করলে রেহাই পাবে না।
দুই মন্ত্রণালয় যাই বলুক না কেন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাই এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি) পরীক্ষার সব বিষয়েরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, পাড়ার ফটোকপির দোকান ও কোচিং সেন্টারগুলো থেকে সাজেশন আকারে আগাম প্রশ্নপত্র পাওয়া যাচ্ছে। দেশজুড়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অভিভাবকদের মুখে মুখে। তাঁরা অভিযোগ করছেন, সাজেশন আকারে পরীক্ষার আগে যেসব প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এর সঙ্গে অনেকাংশে মিল রয়েছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের। বুধবারের প্রাথমিক বিজ্ঞান পরীক্ষায় রচনামূলক প্রশ্নের ক্ষেত্রে এ মিল ছিল ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আর নৈর্ব্যক্তিক, শূন্যস্থান ও সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে মিল ছিল ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এ পরীক্ষার প্রশ্নের ক্রমিক নম্বরের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ক্রমিক নম্বর বা সিরিয়ালে গরমিল রয়েছে আবার প্রশ্নও কিছুটা ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে দেশজুড়েই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এ বিষয়টি। প্রশ্নফাঁসের এ পরিস্থিতিকে ‘মহামারী’ আখ্যায়িত করে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা এ বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।