ডেস্ক,৯ মার্চঃ
প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)-এ নারী প্রশিক্ষণার্থীদের খোদ প্রশিক্ষকের হাতেই যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্তত ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী এভাবে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের পাঠদান ও নীতিনৈতিকতা বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয় পিটিআইতে।
চট্টগ্রামের পটিয়া পিটিআইতে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিবাদে খোদ এক প্রশিক্ষক চার সহকর্মীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি লিখে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। গত শুক্রবার রাতে প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়ার আত্মহত্যাচেষ্টার পর এমন ঘটনা সামনে আসে। ফলে ফুঁসে ওঠেন মুখ বন্ধ রাখা প্রশিক্ষণার্থীরাও।
পিটিআইতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের দেড় বছরের প্রশিক্ষণ হয়। এর মধ্যে এক বছর পিটিআইতে থাকেন তাঁরা। সেখানে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। আর ছয় মাস বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠদান করে থাকেন। প্রতি ব্যাচে ২০০ জন প্রশিক্ষণার্থী থাকেন। তবে পটিয়া পিটিআইতে এখন ১৫০ জনের মতো প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন।
এছাড়া ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগমকে। তিনি রোববার ঘটনা খতিয়ে দেখতে পটিয়া পিটিআইতে উপস্থিত হন। তবেপ্রশিক্ষণার্থীরা চার প্রশিক্ষকের শাস্তি ও আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হননি। তাঁরা কেউ ক্লাসেও যাননি।
চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন দেবব্রত। তবে দুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রোববার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। দেবব্রত অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘চোখের সামনে প্রশিক্ষণার্থীদের চার সহকর্মী যৌন হয়রানি করে যাচ্ছিলেন, কিছু করতে পারছিলাম না।’
তিনি জানান, ‘শিক্ষার্থীরা অনেকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছিলেন না। প্রতিবাদ করেও কিছু করতে পারিনি। তাই শেষে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলাম। জীবনের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে চেয়েছিলাম।’
আন্দোলনের মুখে ওই চার প্রশিক্ষককে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন, শরীরচর্চার প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন, চারু ও কারুকলার শিক্ষক সবুজ কান্তি আচার্য, সাধারণ বিভাগের শিক্ষক জসিম উদ্দিন ও আইটির শিক্ষক রবিউল ইসলাম।
দুপুরের পর চট্টগ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক সুলতান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গিয়ে অভিযুক্ত চারজন প্রশিক্ষককে প্রত্যাহার ও তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। এ সময় প্রশিক্ষণার্থীরা কোনো পিটিআইতে তাঁরা চাকরি করতে পারবেন না বলে দাবি তোলেন এবং স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানান। এছাড়া বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলেন।
সোলতান মিয়া বলেন, ‘অভিযুক্ত চারজনকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২৪ ঘণ্টায় প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। দেবব্রত বড়ুয়া ও প্রশিক্ষণার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না বলেও তিনি আশ্বাস দেন। পরে প্রশিক্ষণার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে সম্মত হন।
পিটিআইয়ের তত্ত্বাবধায়ক তপন কুমার দাশ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আগে শোনেননি তিনি। কেউ অভিযোগও দেয়নি।
দেবব্রত বড়ুয়ার খোলা চিঠিতে অভিযোগ করেছেন, প্রায় ৫০ নারী প্রশিক্ষণার্থী যৌন হয়রানির অভিযোগ স্বীকার হয়েছেন। এর মধ্যে ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১১ সালে পিটিআইতে আসার পর ছাত্রীদের উদ্দেশে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ শুরু করেন। এতে কাউকে বেশি নম্বর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে আবার কারও প্রেমের সম্পর্ক ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে অপকর্ম করেন তিনি।
আর জসিম বিরতির সময় নারী প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষ, করিডোর ও আঙিনায় কথা বলতেন। পরে সম্পর্ক তৈরি করে ‘অপকর্ম’ করতেন। সবুজ চারু ও কারুকলার প্রশিক্ষক হিসেবে মেয়েদের অঙ্গসৌষ্ঠবের শৈল্পিক বিশ্লেষণ ও শাড়ি বা কী ধরনের পোশাকে ভালো দেখাবে, সে পরামর্শ দিতেন। এছাড়া রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক নারী প্রশিক্ষণার্থীকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিয়ে করেননি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ফারুক হোসেন বলেন, ‘ব্যক্তিগত আক্রোশে এ অভিযোগ আনা হয়েছে। ফেসবুকে মিথ্যা অভিযোগ করে মানহানি করায় আইনগত ব্যবস্থা নেব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দেব।’ রবিউল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও সবুজ আচার্যও অভিযোগ অস্বীকার করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। এছাড়া এটাকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহিত করেছেন।
এব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ গণমাধ্যকে বলেন, ‘ওই চারজনকে আপাতত পিটিআইয়ের কর্ম থেকে বিরত রাখা হয়েছে। স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রাথমিকের উপপরিচালককে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।