পাঠ্যবইয়ে হিজড়া: শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্পে তুলকালাম

Image

এবারও বছরের প্রথমদিন সারাদেশে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই তুলে দিয়েছে সরকার। নতুন এসব পাঠ্যবই পেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা তারা। তবে নতুন পাঠ্যবই মানেই যেন ভুল আর বির্তক— এ যেন চিরায়িত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলামের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে একটি অধ্যায় নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

এ নিয়ে সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণের একমাত্র প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে এই অধ্যায়টি গতবছরও ছিল, সেখানে যতটুকু সংশোধন করা দরকার তা এবার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে হিজড়াদেরকে স্বীকৃতি দেয়ায় তাদের সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে। তাই পাঠ্যবইয়ে এটি আনা হয়েছে বলে দাবি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের।

আরও পড়ুন: ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ে যৌনশিক্ষার সুড়সুড়ি

গত নভেম্বরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে হোচিমিন ইসলাম নামে এক ট্রান্সজেন্ডার নারীকে যোগ দিতে না দেয়ায় ইস্যুর পর ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দ বাতিলের দাবিতে বির্তক-আন্দোলন। এবার নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় ‘নতুন পরিচয়’ অংশে বলা হয়েছে, “(স্কুলে) পরের ক্লাসে খুশি আপা একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে। সুমন জানতে চাইল, আপনার নাম কী? তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার।”

পরে ‘শরীফা’ অংশে বলা হয়েছে, “শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং অবাক হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে? শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না….।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

মূলত সপ্তম শ্রেণির এই পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিবন্ধকতা থাকলে সমাজে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও সেখানে তাদের বেড়ে উঠা, সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না থাকা ইত্যাদি উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে।

বইয়ের ৪৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “এ অলোচনায় নিচের প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এসব প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে- আমরা নিজেদের ছেলে এবং মেয়ে বলে আলাদা করে চিনি কীভাবে? ছেলে বা মেয়ে হিসেবে আমরা আমাদের পছন্দের পোশাক, রং, খেলনা, কাজগুলো কী নিজেরাই পছন্দ করি? ছেলেদের খেলনা-মেয়েদের খেলনা, ছেলেদের কাজ-মেয়েদের কাজ কিসের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট করি? একজন মানুষকে বাইরে থেকে দেখেই কি সব সময় সে ছেলে না মেয়ে তা বোঝা যায়? অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে তা আমাদের লিঙ্গগত পরিচয়কে কীভাবে প্রভাবিত করে? এমনটা কি হতে পারে যে, কাউকে আমরা তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখে, গলার স্বর শুনে ছেলে বা মেয়ে বলে ভাবছি কিন্তু সে নিজেকে ভিন্ন কিছু ভাবছে?”

পরে একই পৃষ্ঠার লিঙ্গ বৈচিত্র্য ও জেন্ডারের ধারণা অংশে বলা হয়েছে, “আলোচনা করতে করতে একসময়ে হাস্না বলল, আমার মনে হচ্ছে, আমরা যে মানুষের শারীরিক গঠন দেখেই কাউকে ছেলে বা মেয়ে বলছি, সেটা হয়তো সবার ক্ষেত্রে সত্যি নয়। মামুন বলল, তাই তো! আমরা শরীফার জীবনের গল্প শুনলাম, যিনি দেখতে ছেলেদের মতন, কিন্তু মনে মনে তিনি একজন মেয়ে। তার কাছে এমন একজনের কথা জানলাম, যিনি দেখতে মেয়েদের মতো কিন্তু মনে মনে তিনি ছেলে। খুশি আপা: আমরা চারপাশে দেখে এবং অন্যদের কাছে শুনে জেনেছি যে, শারীরিক গঠন একটা নির্দিষ্ট ধরনের হলে সে ছেলে হয়, অন্য আরেকটা ধরনের হলে সে মানুষটা মেয়ে হয়। ছেলেদের গলার স্বর মোটা, মেয়েদের চিকন। মেয়েরা সাজগোজ করে, তাদের লজ্জা বেশি, তাদের মন নরম হয়। সাধারণত ছেলেরা সাজগোজ করে না, লজ্জা কম পায়, তারা বাইরে যেতে পছন্দ করে। আমরা এগুলোকেই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিচ্ছি। ফাতেমা: কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ছেলেমেয়েদের চেহারা, আচরণ, কাজ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নেই । খুশি আপা: ঠিক বলেছ!”

তবে ফেসবুকে সমালোচকরা বলছেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশের শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে জেন্ডার মনে মনে ধরে নেয়ার বিষয়। দেখতে ছেলে হলেও সে যদি মনে করে সে মেয়ে, তাহলে সে মেয়ে; দেখতে মেয়ের মতো হলেও সে যদি মনে করে সে ছেলে, তাহলে সে ছেলে। কৌশলে শিশুদের মস্তিষ্ক ধোলাই করার চক্রান্ত বলে মনে করছেন তারা। এজন্য এটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহাদী হাসান ফেসবুকে লিখেছেন, আল্লাহর সৃষ্টিকে ভুল প্রমাণ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধর্মবিদ্বেষী ও মানব সভ্যতা বিনাশকারী মতবাদ শেখানোয় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তাহলে শুরু হয়ে গেছে। আস্তাগফিরুল্লাহ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, অনতিবিলম্বে এই বই সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন লিখেছেন, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গ বিকৃতি মতবাদ শিখিয়ে কি অর্জন করতে চায় দেশ? গত ভার্সন নিয়ে সমালোচনার কারণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সংশোধন করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং সেই শব্দটি উল্লেখ করা ছাড়াই সুকৌশলে শিশুদের মস্তিষ্ক ধোলাই করার চক্রান্ত বলে মনে হয়।

“অবহেলিত হিজড়াদের সহানুভূতিকে পুঁজি করে ট্র মতবাদ সংযোজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পিতা হিসেবে অত্যন্ত বিস্মিত, মর্মাহত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে সেই বিকৃত মতবাদকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে দাবি জানাচ্ছি।”

জানা গেছে, গতবছর সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। সেখানে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে ‘সম্প্রদায়’ নামে একটি অধ্যায় ছিল। এবার সেটি সংশোধন করে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ নামে। গতবারও সম্প্রদায় অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী ও এ সংক্রান্ত একটি অনুশীলন ছিল। এবার কিছুটা সংশোধন করা হয়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাষ্ট্রের আইনের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্যে তাদের সর্ম্পকে সমাজে সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন আছে, তাদেরকে বুঝার জন্য। তাই সপ্তম শ্রেণির বইয়ে বিষয়টি গতবছরও ছিল, সেখানে যতটুকু সংশোধন করা দরকার তা এবার করা হয়েছে।

সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, গতকাল মাত্র নতুন বই দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনাগুলো চলুক। আমরা মাসব্যাপী এসব আলোচনা সংগ্রহ করবো। এরপর আমরা বিষয়গুলো সংশোধন প্রয়োজন হলে তা করার সিদ্ধান্ত নেব।

Spurce: the daily campus

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।