দর্শনা থেকে স্বরুপ দাসঃ দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো। একসময়ের লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি বারবার লোকসানের কারণে অর্থসহায়তাও পাচ্ছে না। তাদের সহায়তা করতে আগ্রহী নয় সরকারি-বেসরকারি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এখন তাকিয়ে রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগের দিকে। সেটাও বেশ কয়েক বছর কার্যত প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। সবমিলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দূরের কথা, বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে সংকটের সময় বিদেশ থেকে কিছু চিনি এনে বিক্রি করার সামর্থ্যও নেই বিএসএফআইসির।
এর মধ্যে কয়েক মাস আগে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি এ প্রতিষ্ঠানকে রমজানে চিনির সংকট মেটাতে চিনি আমদানির সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেটাও পারেনি অর্থ না থাকায়।
তথ্য বলছে, কয়েক দশক ধরে লোকসানে চলছে বিএসএফআইসি। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় চার হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৯৭২ কোটি টাকা। তার আগের বছরও (২০১৯-২০ অর্থবছর) লোকসান ছিল ৯৭০ কোটি। সব মিলিয়ে আট হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংকঋণের দায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ওপর।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শেষ ২০২০-২১ অর্থবছর রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনগুলোর লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) লোকসান সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশন (বিসিআইসি) এবং তৃতীয় ধাপে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)।
এসব বিষয়ে বিএসএফআইসি চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু বলেন, চেষ্টা করা হচ্ছে কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি আগের অবস্থায় ফেরানো যায়। বেশকিছু কার্যক্রম চলছে। আশা করা যাচ্ছে এ দুরবস্থা কেটে যাবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন গঠিত হয়। পরবর্তীসময়ে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন একত্রীভূত হয়ে গঠিত হয় বিএসএফআইসি। বর্তমানে করপোরেশনের ১৫টি চিনিকল, একটি ইঞ্জিনিয়ারিং, একটি ডিস্টিলারি ও একটি জৈবসার কারখানা আছে। তবে ১৫টির মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ রাখা হয়েছে ২০২০ সাল থেকে।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনির পাশাপাশি আখের উপজাত দিয়ে জৈব সার, অ্যালকোহল, স্পিরিট, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদিত করে মুনাফা করছে। বাকি সবগুলো প্রতিষ্ঠান লোকসানি। কেরু চিনি বিক্রি করে লোকসান করলেও উপজাত পণ্যের বদৌলতে বছরে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা মুনাফা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।
এ সংস্থার সবচেয়ে বড় আয়ের জায়গা চিনি উৎপাদন। কিন্তু চিনিকলগুলোর বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা দুই লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন হলেও সবশেষ মৌসুমে (২০২১-২২ অর্থবছর) উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন। দেশের বাজারে বছরে ২০ লাখ টনের বেশি চিনির চাহিদা রয়েছে। সেটা পূরণ হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। এতে বিদেশে যাচ্ছে বছরে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি।
এদিকে অর্থাভাবে এ করপোরেশন এখন চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি আখ চাষেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কয়েক মৌসুম থেকে নিবন্ধিত আখচাষিদের সার, কীটনাশক ও সেচের জন্য ঋণ দিতে পারেনি। ফলে দ্রুত কমছে আখের উৎপাদন। এতে পরবর্তীসময়ে চাইলেও বেশি চিনি উৎপাদনের কাঁচামাল সংকটের শঙ্কায় পড়ছে কলগুলো।
করপোরেশনের অধিকাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, বর্তমানে চিনিকল দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান লাভজনক অবস্থানে ফেরানো সম্ভব নয়। কারণ দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে তিনটি ত্রিশের দশক, তিনটি পঞ্চাশের দশক, সাতটি ষাটের দশক ও দুটি বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে স্থাপিত হয়েছে। অধিকাংশ চিনিকলের যন্ত্রাংশ অতি পুরোনো ও জরাজীর্ণ। এসব চিনিকলে উৎপাদন খরচ বিক্রিমূল্যের কয়েকগুণ বেশি।
এছাড়া লোকসানের আরও কিছু কারণ রয়েছে। গত বছর নিজেদের ক্রমাগত লোকসানের পেছনে আটটি কারণ চিহ্নিত করেছিল খোদ সংস্থাটিই। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনির উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রিমূল্য কম হওয়া, বিশ্বব্যাপী চিনির দাম কমে যাওয়া, পুঞ্জীভূত ঋণ ও সুদের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া, পোকা ও রোগবালাই প্রতিরোধে সক্ষম আখের জাত উদ্ভাবন না হওয়া, দীর্ঘদিনের পুরোনো ও জরাজীর্ণ কারখানা, বেসরকারিখাতে আমদানি করা ‘র’ সুগার থেকে পরিশোধিত চিনি উৎপাদন করে কম দামে বাজারজাতের ফলে বিএসএফআইসির চিনি অবিক্রীত থাকা, আখের মূল্য ও চিনির মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকা, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও চিনি সংগ্রহের হার কমে যাওয়া।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শিল্প মন্ত্রণালয় কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সেটা জানতে কথা হয় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিএসএফআইসি ও বিএসইসি) ড. মো. আল-আমিন সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটি আবার লাভজনক করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। সেটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ।