পদোন্নতি পেতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য বরিশালে বড় অংকের ঘুষের তহবিল করার ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করেনি পুলিশ। এই ঘটনায় বরিশাল মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের কাকে বা কোন কর্মকর্তাদের এই ঘুষ দেয়া হতো, তা খুঁজে বের করতে চায়নি পুলিশ সদর দপ্তর।
৭৭ লাখ টাকা ঘুষের তহবিল করার ঘটনায় দুর্নীতি মামলাও হয়নি অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, ঘুষ নিয়ে পছন্দসই এলাকায় বদলির ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া পুলিশের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ইচ্ছে করেই বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে।
২০১৫ সালের জুনে বরিশাল মহানগর পুলিশের বিভিন্ন পদে কর্মকত পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য ঘুষ দিতে ৭৭ লাখ টাকার তহবিল গঠন নিয়ে তোলপাড় হয়। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর ১ জুলাই মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) জিল্লুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তারও আগের দিন ১০ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদরদপ্তর। তারা হলেন: সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনিসুজ্জামান, মনির হোসেন ও হানিফ, নায়েক কবির হোসেন, কনস্টেবল তাপস কুমার, তিন গাড়ি চালক শহীদুল ইসলাম, বাবলু জোমাদ্দার ও দোলন বড়াল, এবং রেশন স্টোরকিপার আব্বাস উদ্দিন ও আরিফুর রহমান।
এই ঘটনায় জিল্লুর রহমানের বিভাগীয় শাস্তি হয়েছিল। তিনি বর্তমানে সিলেট উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) রেঞ্জের কার্যালয়ে সংযুক্ত হয়েছেন। এই ঘটনায় তার শাস্তি হয় দুটি। তার চার বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি আটকে দেয়া হয়, আর এখনও তিনি কোনো দায়িত্ব পাননি। শুধু অফিসে যান এবং বেতন তুলে নেন।
ওই ঘুষের তহবিল গড়ার ঘটনায় আরো ১০ জন পুলিশ সদস্যকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে তারাও বিভাগীয় শাস্তি পান। কিন্তু তারা এখন কোথায় আছে তাদের কী শাস্তি হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
২০১৪ সালে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পদোন্নতি হচ্ছিল না বরিশাল মহানগরে কর্মরত ২৩০ পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি। তাদের পদোন্নতি পাইয়ে দেবেন এমন কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে এই অংক দাঁড়ায় ৭৭ লাখ টাকা।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পরে বরিশালের পুলিশ কমিশনার শৈবাল কান্তি চৌধুরী একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
ঘুষের সেই টাকা রাখার জন্য ডাচ বাংলা ব্যাংকের বরিশাল শাখায় যৌথ হিসাব খুলেন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আনিসুজ্জামান, নায়েক কবির হোসেন ও চালক বাবলু জোমাদ্দার। ৭৭ লাখ টাকার মধ্যে ১৭ লাখ টাকা ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়েছিল। বাকি ৬০ লাখ টাকা ছিল সে সময়ের বিএমপি উপ-কমিশনার জিল্লুর রহমানের কাছে।
জানতে চাইলে সিলেট রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ মহাপরির্দশক নজরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জিল্লুর রহমান এখনও আমাদের সিলেটের ডিআইজি অফিসে অ্যাটাচে আছেন। তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরই ভালো বলতে পারবেন।’
কার কাছে যেত এই টাকা?
পুুলিশে পদোন্নতি বা সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং পেতে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পুরনো। বরিশালের ঘুষ তহবিল গঠনের পর বিষয়টি একেবারে প্রকাশ্যে চলে আসে। ঘুষের এই টাকা পুলিশ সদরদপ্তরের কোথায় যেত তা তদন্ত করে বের করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি ওঠে।
কিন্তু বরিশালে পুলিশের পদোন্নতির জন্য গড়া তহবিল সদরদপ্তরে কে বা কাদের কাছে আসত, সেই বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হয়েছে কি না-এ বিষয়ে কর্মকর্তারা কিছুই বলছেন না। তবে এই ঘটনায় সদরদপ্তরের যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, সেটা নিশ্চিত করেছেন তারা।
জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পদোন্নতির জন্য ঘুষের তহবিল করার ঘটনায় বিভাগীয় ব্যবস্থা তো কোনো শাস্তি হলো না। এসব ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রচালিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে কার জন্য ঘুষের তহবিল করা হয়েছিল, সেটা তো খুঁজে বের করা জরুরি ছিল। পুলিশ সেটা না করলে এই তদন্ত পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না কোনোমতেই।’
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুনীতি দমন কমিশনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচায্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেছিল কি না তা আমার জানা নেই। এটা প্রায় তিন বছর আগের কথা।’
কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই শাস্তি যথেষ্ট নয়। এ ঘটনার ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত ছিল। তবে তখন কেউ অভিযোগ করেছিল কি না তা আমার জানা নেই। তখন অনেক গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।’ প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করা যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই যায়। তবে বিষয়টি দুদকের নলেজে আছে কি না তা আমি জানি না।’
এ ব্যাপারে জানতে বরিশালে ঘুষের তহবিল গড়া পুলিশ কর্মকর্তা জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকার যোগাযোগ করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।