জেলা প্রতিনিধি,৩ আগষ্ট ২০২২:
নড়াইল জেলা সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছনার ঘটনার দীর্ঘ ৪৬ দিন পর কলেজে ফিরেছেন তিনি। বুধবার সকাল দশটার দিকে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ক্যাম্পাসে পৌঁছলে পরিচালনা পরিষদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি ও এলাকার সুধীজনেরা অধ্যক্ষের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক। পরে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশে সংক্ষিপ্ত এক সম্প্রীতি সমাবেশ শেষে তিনি তার আসনে বসেন।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজে ফেরায় খুশি শিক্ষার্থীরা।
এর আগে লাঞ্ছনার ঘটনায় এক মাস পাঁচদিন বন্ধ থাকার পর গত ২৪ জুলাই কলেজ খুলে। তখন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই ক্লাসে ফিরলেও অধ্যক্ষ এতদিন অনুপস্থিত ছিলেন।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকাল ১০টার দিকে কলেজ পরিচালনা কমিটির আয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এলাকার সুধীজনদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ কলেজ হলরুমে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আব্দুস সালাম হাওলাদার, রেজিস্ট্রার মোল্যা মাহফুজ আল হুসাইন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের ডাইরেক্টর এএসএম রফিকুল আকবর, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা রেড ক্রিসেন্টের সম্পাদক কাজী ইসমাইল হোসেন লিটন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এসএ মতিন, সমাজসেবক কল্যাণ মুখার্জী প্রমুখ।
গভর্নিং বডির সভপতি অ্যাড. অচিন কুমার চক্রবর্তী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. সুভাষ চন্দ্র বোস, গভর্নিং বডির সদস্য আনিসুর রহমান প্রমুখ।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘অপরাধ না করেও অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। এই কলেজে ফেরা নিয়ে শঙ্কা ছিল। সব শঙ্কা কেটে গেছে। অনেক দিন পর নিজের প্রাণের ক্যাম্পাসে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে। গভর্নিং বডি আমার সঙ্গে আছে। এলাকাবাসী তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন সবাই যখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তখন আশা দেখছি।’ তিনি আশা করছেন, আর কোনো সমস্যা হবে না। আগের মতোই কলেজে নিজের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবেন।
নড়াইল-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য বিএম, কবিরুল হক মুক্তি বলেন, অসাম্প্রদায়িক নড়াইলে একটি চক্র অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য পরিকল্পিতভাবে মির্জাপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারী যেই হোক না কেন তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী মুক্তা বিশ্বাস বলেন, অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস খুব ভালো একজন শিক্ষক। ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে তাকে লাঞ্ছিত করার কারণে মাঝখানে একটা খারাপ সময় পার হয়েছে। স্যার আবার কলেজে ফিরে আসায় আমরা খুব খুশি।
স্বপন কুমার বিশ্বাসের সহকর্মী শ্যামল কুমার ঘোষ বলেন, ‘স্বপন কুমার বিশ্বাস দীর্ঘদিন কলেজে না থাকায় একটা শূন্যতা ছিল। আজ যোগ দেওয়ার পর আবার সবকিছু পূর্ণ হলো।’
প্রসঙ্গত, গত ১৭ জুন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় ওরফে বাপ্পী রায় নিজের ফেসবুক আইডিতে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে পোস্ট করেন, ‘প্রণাম নিও বস ‘নূপুর শর্মা’ জয় শ্রীরাম’। বিষয়টি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে কলেজের কিছু ছাত্র তাকে সেটি মুছে (ডিলিট) ফেলতে বলেন। এরপর ১৮ জুন সকালে অভিযুক্ত ছাত্র কলেজে আসলে তার সহপাঠীসহ সকল মুসলিম ছাত্র তার গ্রেফতার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের দাবি তুলে অধ্যক্ষের নিকট বিচার দেয়। কিন্তু ওই সময় ‘অধ্যক্ষ একই সম্প্রদায়ের লোক হওয়ায় তাকে রক্ষা করার চেষ্টায় ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’- এমন কথা রটানো হলে উত্তেজনা তৈরি হয়।
এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে উত্তেজিত জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষে হয়। সংঘর্ষে দুই পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এরপর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাদের উপস্থিতিতেই উত্তেজিত জনতা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায়ও জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করে। এ নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে এ ঘটনায় মামলা দায়ের এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তদন্ত দল গঠন করে। এরপর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।