নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২২ সালের প্রথমদিন থেকে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠদান শুরু হয়েছিল। শুরুতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং বাকি শ্রেণিগুলোতে চলতি ২০২৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এই শিক্ষাক্রম চালু করে সরকার।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের প্রচলিত শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের মূল কারিগর অর্থাৎ শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঠিক ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার সাথে পঠন-পাঠন সম্পন্ন করতে পারেন, সেজন্য শুরুতেই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে শিক্ষাক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের তদারকি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের শুরুতে বিগত বছরের গোড়ার দিকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রতিষ্ঠান মাউশি ও এনসিটিবি। সরকারের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের শুরুতে বদলে যাওয়া শিখন ও মূল্যায়ন কাঠামোয় শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ নেন দেশের মাধ্যমিক স্তরভিত্তিক শিক্ষালয়গুলোর দুই লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি শিক্ষক। নতুন শিক্ষাক্রমের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম থেকে বিভিন্ন কারণে তখন বাদ পড়েছিলেন প্রায় এক লাখ ২০ হাজারের মতো শিক্ষাগুরু। অবশ্য নতুন উদ্যোগে প্রশিক্ষণ পাবেন বাদ পড়া শিক্ষকরা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছর নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ পাবেন শিক্ষকরা। এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ৬ শত ২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষণ পাবেন দেশের চার লাখ ২৫ হাজার ২৫০ জন শিক্ষক। এছাড়াও একই স্কিমের আওতায় প্রশিক্ষণ পাবেন শিক্ষা অফিসার এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাসহ আরও মোট ২ হাজার ২শ’ কর্মকর্তা। এর মধ্যে থাকবেন মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও।
তবে এ প্রশিক্ষণের জন্য মাউশির চাহিদা ছিল ৮ শত ৩৭ কোটি টাকা। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে সবশেষ ৬ শত ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত বরাদ্দকৃত ৬ শত ২ কোটি টাকার মধ্যে মাউশি চলতি বছরের বিভন্ন প্রশিক্ষণে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করেছে। এর মধ্যে অধিদপ্তর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাবদ ৪ শত ৪ কোটিরও বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে মাউশির পক্ষ থেকে।
দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার এ তদারক সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের শুরুতে প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হলে শিক্ষকদের এসব ক্লাসের পাঠ্য বইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এ বছর নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠের আওতায় আসবে দ্বিতীয়, অষ্টম এবং নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা; সেজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এসব শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বিষয়গুলোর তদারকি করছে মাউশি।
এর আগে সরকার বিগত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর আগে মাধ্যমিক স্তরের তিন লক্ষাধিক শিক্ষককে শুরুতে এক ঘণ্টা করে অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়। এর আগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) একই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষককে পাঁচ দিনের সশরীর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পথরেখা ঠিক করে দিয়েছিল। এরপর শিক্ষকরা পাঁচদিন সশরীর প্রশিক্ষণ পান চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।
আরও পড়ুন:আগামী বছরের এইচএসসি পরীক্ষা এপ্রিলে
চলতি নতুন শিক্ষাক্রমটি প্রণয়ন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। আর মাধ্যমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ দক্ষতা উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের কাজটি করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এবারের নতুন শিক্ষাক্রমে জোর দেয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-পঠন ও মূল্যায়নকে। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হওয়ার কথা রয়েছে।
এতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। আর দুটিই থাকছে পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমে। পাশাপাশি বাদ দেয়া হয়েছে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও। যা শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে নতুন শিক্ষাক্রমে।
এর আগে গত বছরের মে মাসে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে পথরেখা দেয় এনসিটিবি। এতে বলা হয়, মাধ্যমিক স্তরে ৬৪ জেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন করে মূল প্রশিক্ষক বা মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। তাঁরা আবার প্রতিটি উপজেলায় প্রতি বিষয়ে তিনজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন।
২০২১ সালের মে মাসে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম—দুটোই থাকছে।
নতুন নিয়মে এখনকার মতো করে হবে না এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি শিক্ষাবর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।
এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে রাখা হয়নি দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বেন—তা ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গিয়ে। সেজন্য ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। চলমান শিক্ষা কাঠামোয় এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিভাগ নির্ধারণও বর্তমানে ঠিক হয় নবম শ্রেণিতে গিয়ে।
আরও পড়ুন: নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত, যা থাকছে
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণি ও ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য নির্ধারিত কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) চালু রয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণিতে তা পর্যায়ক্রমে চালুর সুযোগ রাখা হয়েছে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
তখন এনসিটিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বিগত বছরের শেষ দিকে এবং চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কাজ শেষ করেছে মাউশি। যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনভিত্তিক মূল্যায়ন এবং প্রথাগত ধারার বাইরে যাওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে শিক্ষককে বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সেজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। শিক্ষকরা যাতে প্রশিক্ষণের বাইরে না থাকেন—সেজন্য নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং এতে বাদ পড়া সকল শিক্ষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) স্কিম শাখার পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী জানিয়েছেন, আমরা সকল শিক্ষককে এবারের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, এবারের প্রশিক্ষণের অষ্টম ও নবম শ্রেণি নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আসছে। সেজন্য আমরা পরবর্তী ক্লাসগুলোর প্রশিক্ষণ চলতি বছরের মধ্যেই শেষ করব। কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণের বাইরে থাকলে তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাতে পারবেন না। ফলে বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা; আমরা কোনো শিক্ষার্থীকে নতুন শিক্ষাক্রম থেকে বঞ্চিত করতে চাই না।