নিজস্ব প্রতিবেদক | :
দুর্নীতি ও পছন্দের ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্যের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’ স্থাপন প্রকল্পের কেনাকাটা সাময়িক বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ফলে সরকারের অগ্রাধিকারের এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরুতেই হোঁচট খেল। প্রকল্প দলিল (ডিপিপি) ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দরপত্র আহ্বানের তৎপরতা চালানোর কারণে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সতর্কও করেছে শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রকল্প কর্মকর্তারা নিজের মতো করেই সব ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান।
দেশের তিন হাজার ৩৪০টি হাই স্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করতে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার নাম ‘আইসিটি’র মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (২য় পর্যায়)’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স ও মডেম- ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে।
কিন্তু শিক্ষা উপকরণ ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়ে প্রকল্পের শুরুতেই দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে একটি চক্র। তারা উন্মুক্ত দরপত্রে কেনাকাটার চিন্তা বাদ দিয়ে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনাকাটা করতে চান। এতে চক্রটি একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন তথা ‘অনৈতিক সুবিধা’ পাবে।
সম্প্রতি আইসিটি প্রকল্পের অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর আলোকেই গত ১৯ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মহিউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা, প্রকল্প কর্মকর্তা ও মাউশির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এই সভায় অতিরিক্ত সচিব মহিউদ্দিন খান আইসিটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কাছে ক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র ও নথি তলব করেন। একইসঙ্গে তিনি মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সব ক্রয় প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তবে চীন সফরে থাকায় প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দীন ওই সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। পরে প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিতের কথা শুনে চীন সফর সংক্ষিপ্ত করে গত সপ্তাহে দেশে ফেরেন। প্রকল্পের কেনাকাটা ফের চালু করতে তিনি এখন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
অতিরিক্ত সচিবের বক্তব্যের আলোকেই প্রকল্পের কেনাকাটায় স্বেচ্ছাচারিতা সংক্রান্ত বিষয়ে আইসিটি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে কড়া ভাষায় সতর্ক করেন মাউশি মহাপরিচালক। তবে মহাপরিচালক প্রকাশ্য সভায় প্রকল্প কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি দিলেও তার পরামর্শেই ডিপিএম প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে বলে আইসিটি প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান।
মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বেসরকারি ‘স্মার্ট টেকনোলজি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি’র কর্মকর্তাদের চাপ দিচ্ছে একটি বিশেষ সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। সিলেটের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিও ডিপিএম’ প্রক্রিয়ায় ‘স্মার্ট টেকনোলজি’র মাধ্যমে কেনাকাটা করতে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছেন। মাউশি মহাপরিচালকও চান ‘স্মার্ট টেকনোলজি’ কাজ পাক।
কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, জটিল ও অনিবার্য কোন কারণ ছাড়া প্রকল্পের কেনাকাটায় ডিপিএম প্রক্রিয়া অনুসরণের কোন সুযোগ নেই। উন্মুক্ত দরপত্র বা ‘ই-জিপি’ (ইলেক্ট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) অর্থাৎ অনলাইনে দরপত্র আহ্বান করে শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করতে হবে। প্রকল্পের দলিলেও তাই বলা হয়েছে।
এই প্রকল্পের কাজ পেতে সরকারি-বেসরকারি আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নানাভাবে চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছে। এর মধ্যে ‘থেসিস’ ও ‘ডকইয়ার্ড’ নামের দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, ‘ইউনিক’, ‘ওরিয়েন্টাল’ ও ‘গ্লোবাল’সহ আরও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অন্যতম।
জানা গেছে, আইসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ৩৪০টি স্কুলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা আরও প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি হাই স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে; সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব উদ্যোগে সোলার সিস্টেম (সৌর বিদ্যুৎ) স্থাপন করতে হবে।
আর কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যদি নিজস্ব উদ্যোগে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করে সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের অর্থায়নে ওই প্রতিষ্ঠানে ‘বোনাস’ হিসেবে আরেকটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করে দেবে সরকার।
‘আইসিটি’র মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপনে সরকারের ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন নাগাদ।