নিজস্ব প্রতিবেদক: কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ রাজধানীর স্বনামধন্য আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৯৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।এরপরও ভিকারুননিসার অভিযুক্ত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ফারহানার কোচিং ব্যবসা থেমে নেই। সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বৈগর গলির একটি বাসায় চলছে তার কোচিং সেন্টার। মঙ্গলবার (০৫ ডিসেম্বর) সকালে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে।
গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ কোচিং বাণিজ্যে জড়িত ৯৭ শিক্ষকের কর্মস্থল রাজধানীর আটটি স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের কাছে তালিকা পাঠায় দুদক।
এ বিষয়ে জানতে মঙ্গলবার সকালে প্রিন্সিপাল নাজনীন ফেরদৌসের সঙ্গে কথা বলতে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজে গেলে নিরাপত্তারক্ষী একটি ফরম ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখানে নাম-ঠিকানা পূরণ করতে হবে। কী কারণে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে চান সেটিও উল্লেখ করতে হবে।’ তবে ফরম পূরণ করেও প্রিন্সিপাল সাক্ষাতের সুযোগ দেননি। ওই নিরাপত্তারক্ষী ফিরে এসে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ম্যাডাম এখন ব্যস্ত আছেন। আপনার কার্ড দিয়ে যান, পরে তিনি ফোন করে কথা বলবেন।’ কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলেও তিনি এ প্রতিবেদককে ফোন করেননি।
দুদকের তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রভাতী শাখার সহকারী শিক্ষক কামরুন্নাহার চৌধুরী (ইংরেজি ভার্সন), ড. ফারহানা (পদার্থবিজ্ঞান), সুরাইয়া নাসরিন (ইংরেজি), লক্ষ্মী রানী, ফেরদৌসী ও নুশরাত জাহানের নাম রয়েছে। মঙ্গলবার ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষীর মাধ্যমে বার্তা পাঠালেও তারা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
ভিকারুননিসার পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. ফারহানা রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বৈগর গলির ৬৪ নম্বর বাসার প্রথম তলায় দুটি কক্ষ নিয়ে কোচিং পরিচালনা করেন। মঙ্গলবার সকালে সেখানে গিয়ে যায়, কোচিং সেন্টারটির বাইরে কোনও সাইনবোর্ড নেই। তবে সেন্টারটির বাইরের দরজার ওপরে সাইনবোর্ড থাকলেও সেটি যে খুলে ফেলা হয়েছে তার ছাপও চোখে পড়ে।
সেখানে গিয়ে দরজায় টোকা দিতেই বের হয়ে আসেন দুই নারী। তারা নিজেদের নাম না বলে শুধু কোচিং সহকারী বলে পরিচয় দেন। দরজা দিয়ে ভেতরে দেখা যায়, কক্ষ দুটিতে সারি সারি বেঞ্চে বসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তবে সেখানে শিক্ষক ফারহানাকে পাওয়া যায়নি।
কোচিং সহকারী দুজনই পরীক্ষা তদারকি করছেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা বলেন, ‘ম্যাডাম আমাদের রেখেছেন কাজের জন্য। তাই কাজ করি। এছাড়া আর কিছু জানি না।‘ তারা আরও বলেন, ‘ম্যাডাম সকাল থেকে কোচিংয়ে আসেননি, আজ সারাদিনেও আসবেন না।’ ড. ফারহানার ফোন নম্বরও দেননি তারা। এরপর তারা তড়িঘড়ি করে দরজা লাগিয়ে দেন।
পরে কোচিং শেষে কয়েকজন ছাত্রী বের হয়ে এলে তাদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলে, ফারহানা ম্যাম অনেক ভালো পড়ান, তাই তার কাছে পড়ি। ড. ফারহানা নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞানের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে এই কোচিংয়ে পড়ান বলেও জানান ওই ছাত্রীরা।
এসময় ফরিদা পারভিন নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমরা অভিভাবকরা কোচিংয়ের পক্ষে। কারণ, স্কুলের একটা শ্রেণিকক্ষে অন্তত দেড়শ শিক্ষার্থীকে বসিয়ে ক্লাস নিতে হয় শিক্ষকদের। ক্লাসও হয় অল্প সময়। এত শিক্ষার্থীর মধ্যে কিভাবে একজন শিক্ষক সবাইকে ধরে ধরে বোঝাবেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ আছে। এখনকার পড়াশোনা অনেক কঠিন। তার ওপর অনেক প্রতিযোগিতা। এখানে টিকে থাকতে হলে কোচিং ছাড়া কোনও উপায় তো খোলা নেই।’
এই অভিভাবক বলেন, ‘একজন শিক্ষককে বাসায় রেখে পড়াতে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা লাগে। এত টাকা দিয়ে শিক্ষক রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার স্কুলেও ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না, কিন্তু এর দোষ তো শিক্ষকদের নয়। শিক্ষার্থী বেশি, প্রতিযোগিতা বেশি, পড়াশোনা কঠিন। ফলে কারোরই কিছু করার নেই। সরকারকেই এর সুষ্ঠ সমাধান বের করতে হবে।’
কিভাবে সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে এক সঙ্গে বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে পড়াতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। কারণ, শিক্ষক সংকট এমনকি শ্রেণিকক্ষ সংকটও থাকে। এ সংকট দূর করতে হবে। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে কয়েকটি গ্রুপে ক্লাস নিতে হবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে। এছাড়া, পড়াশোনাও একটু সহজ করতে হবে। এগুলো হলেই আমি মনে করি কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হবে।’
ড. ফারহানার সঙ্গে কথা বলতে আবারও ভিকারুননিসা স্কুলে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষী আব্দুল কাদেরের মাধ্যমে ভিজিটিং কার্ড পাঠালে তিনি ফিরে এসে জানান, ‘ম্যাডাম ব্যস্ত আছেন। কথা বলতে পারবেন না।’
বাংলা টিব্রিউন।