ডেস্ক: দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্বে’ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দল-সমর্থক শিক্ষকেরা। এ জন্য আলাদা সংগঠনও গড়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান উপাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষকদের নতুন সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। এই সংগঠনভুক্ত শিক্ষকেরাই এখন সব ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছেন।
আর পুরোনো সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক উপাচার্য। শিক্ষকদের এই পক্ষ এখন বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভর্তিতে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে রংপুর ও আশপাশের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ তুলছেন। এ ছাড়া তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠলেও বর্তমান প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। একাধিক শিক্ষক বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে।
১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়টিতে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ও ২৮৫ জন শিক্ষক রয়েছেন।
অবশ্য বর্তমান উপাচার্য মু. আবুল কাসেমের সঙ্গে দেখা করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ওই সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্য, শিক্ষকদের একটি পক্ষকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া এবং আঞ্চলিকতার অভিযোগ সত্য নয়। ভর্তি নিয়ে অভিযোগও ভিত্তিহীন। আর যাঁদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে, তাঁর মধ্যে গুরুতর অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য নির্ধারিত কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান উপাচার্য নিয়োগ পান। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর আগে উপাচার্য ছিলেন রুহুল আমিন। সাবেক উপাচার্যের পক্ষের শিক্ষকদের চেষ্টা ও আশা ছিল, রুহুল আমিনই আবার উপাচার্য হবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবে শেষ পর্যন্ত তিনি উপাচার্য হতে পারেননি। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে দিনাজপুরের স্থানীয় তিনজন সাংসদ পক্ষ-বিপক্ষে ভূমিকা নেন। এখনো এর প্রভাব কাজ করছে। রুহুল আমিন প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের সভাপতি, আর সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিনের সময় রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক বলরাম রায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, মূলত উপাচার্যের পদটি ঘিরেই ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ শুরু হয়। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষকদের আরেকটি অংশ তাঁর পক্ষ নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষক পরিষদ’ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। এই সংগঠনের সভাপতি মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক। নতুন উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের শিক্ষকদের ধীরে ধীরে সরানো শুরু হয় এবং নতুন সংগঠনের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে দায়িত্বে পেতে থাকেন। তখন দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে।
নতুন সংগঠনটির একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, এখন মনে হচ্ছে, এই সংগঠন মূলত উপাচার্যের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে এবং ক্ষমতা ভোগ করতে শুরু করেছেন কয়েকজন শিক্ষক। একটি পক্ষ আগে ‘বিজনেস’ করেছে, এখন আরেক পক্ষ চেষ্টা করছে। এখানে রংপুর বনাম দিনাজপুরকেন্দ্রিক দুটি উপদল হয়ে গেছে। উপাচার্যের বাড়ি লালমনিরহাটে হওয়ায় তিনি রংপুর অঞ্চলের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সম্প্রতি মাস্টাররোলে ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা না হলেও কিছু কিছু বিষয় দৃশ্যমান হচ্ছে। গত নভেম্বরে সংবাদ সম্মেলন করে চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ তোলে প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরাম। ওই সংবাদ সম্মেলনের পর প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের অধ্যাপক এস এম হারুন উর রশিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পরামর্শ বিভাগের পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেয় বর্তমান প্রশাসন। এ ঘটনার প্রতিবাদে প্রগতিশীল শিক্ষক ফোরামের ডাকা অবস্থানে উপাচার্যের সমর্থক একদল শিক্ষার্থী হামলা করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বলরাম রায় বলেন, বিভিন্ন ঘটনায় শিক্ষকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে যে লক্ষণ শুরু হয়েছে, সেটা ভালো মনে হচ্ছে না। যদিও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষক পরিষদ’-এর নেতা অধ্যাপক মো. মিজানুর রহমান বলেন, দলাদলি সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকায় উপাচার্যই সবকিছুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
যৌন হয়রানির যথাযথ বিচার হয় না
গত বছরের জুলাই মাসে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ওই বিভাগের এমএসের এক ছাত্রী যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযুক্ত ওই শিক্ষক ওই ছাত্রীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পরে তদন্ত কমিটির ভিত্তিতে ওই শিক্ষককে সতর্ক করা হয় এবং এক বছর কোনো শিক্ষার্থীকে এমএস ডিগ্রির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
একাধিক শিক্ষক বলেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রীও মামলা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে। এমন অবস্থায় তাঁর বিষয়ে গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক বর্তমানের প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে প্রশাসন।
ফিশারিজ অনুষদের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলেও তাঁকে সম্প্রতি একটি আবাসিক হলের সহকারী হল সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে মানববন্ধন, কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। কিন্তু তাঁকে রোভার স্কাউটের একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকেও যৌন হয়রানিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানো হচ্ছে।