দুচোখের পাপড়ি ভিজে যাওয়া এক করুন কাহিনী ! স্ত্রীর হাতের বালা বেচে পাঠাগার নির্মাণ

বাচিয়ে রাখতে সন্তানের দুধের টাকা দিয়ে পত্রিকার বিল পরিশোধ

স্বরুপ দাসঃ চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিল্প শহর দর্শনা। যার পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গা নদী। যে শহরে অবস্থিত বিখ্যাত কেরু এ্যন্ড কোম্পানি, শান্ত শিষ্ঠ শহর হিসাবে পরিচিত যে শহর সেই শহরে  থাকবে না কোন সাদা মনের মানুষ তা কি হয়। পত্রিকায় বিভিন্ন সাদা মনের মানুষের কথা পড়েছি, একা একা চোখের জল ফেলেছি কিন্তু বাস্তবে দেখা হয়ে ওঠেনি। দর্শনায় বাস করার সুবাদে আimage CDLবু সুফিয়ানের সাথে পরিচয় সেই ১৯৯২ সাল থেকে। জ্ঞানপিপাসু মানুষের ভালোবাসা নিয়ে জীবনের অন্তিম শয়নও যেন গ্রন্থাগারের পাশে হয়ত বলতে বলতে আবু সুফিয়ানের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে একটি দীর্ঘশ্বাস। এক সময় দু’চোখের পাপড়ি ভিজে যায়। সুফিয়ান  বলেন, ‘সন্তানের দুধের টাকা, স্ত্রীর হাতের সোনার বালা,এবং জমিজমা বিক্রিসহ জীবনের সব সম্বল বিক্রি কওে কোনোরকমে বাঁচিয়ে রেখেছি এ গ্রন্থাগারটি।’
নদীর  জলধারা যেমন নীরবে প্রবাহিত হতে হতে একটি পর্যায়ে থেমে যায় ঠিক তেমনি বহু সংগ্রাম করে কোন রকমে  একটি গ্রন্থাগার। দর্শনার একমাত্র গ্রন্থাগার যাকে সবাই গন উন্নয়ন গ্রন্থাগার বলে চেনে।
যার হাল ধরে রেখেছেন আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী। বিলিয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানের আলো।
প্রাচীন এই জনপদের কেরুজ কোয়ার্টারে ১৯৬৮ সালের ৫ মার্চ জন্ম নেন আবু সুফিয়ান। বাবা মরহুম এসকান্দার এবং মা মোছাঃ  রিজিয়া বেগম কেরু অ্যান্ড কো¤পানিতে চাকরির সুবাদেই  আসেন দর্শনাতে।
তিনি ছিলেন পাওয়ার ইঞ্জিন ড্রাইভার। সামান্য এই চাকরি করেও তিনি ভাবতেন তার সন্তানরা সবাই লেখাপড়া করে আলোকিত মানুষ হবে। আবু সুফিয়ান এর শিক্ষাজীবন শুরু কেরু প্রাইমারি স্কুলে। গোপালগঞ্জ বঙ্গঁবন্ধু কলেজ থেকে øাতক ড্রিগ্রি অর্জনের পর  এক সময়ের সহপাঠী সেলিনা আক্তার কনকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ভালোবাসার বন্ধনে। অবশেষে বিবাহ বন্ধনে আর্বিভুত হন। ভালোবাসায় হৃদয়ের আহার জুটলেও মাথার ওপর ছাউনি আর পেটের আহার কীভাবে জুটবে সে পথ ছিল অজানা। রোজগারহীন দিনগুলোতে প্রায়ই শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন সুফিয়ান। তিন বেলা খাবার না জুটলেও, ভালোবাসার সঙ্গী সেলিনা আক্তার কনক স্বামীর চোখে চোখ রেখে যেন ভুলে যান আহারবিহীন দিন-রাত্রি। আলোকিত এই মানুষটির যখন সবাইকে আলোকিত করার কথা ভাবেন তখন তার নিজের ঘওে থাকে না বাতি। আধাওে রাত কাটাতে হয়।  খাবার সংগ্রহের নেশায় মাঝে মাঝে শুধু ভাবেন কিন্তু করার কিছুই থাকে না।  যখন খাবার জোটে তখন খান। না পেলে খালি পেটেই কাটিয়ে দেন সময়। পেরিয়ে যায় আরও একটি দিন। আবার ভোর হয়। যথারীতি গ্রন্থাগারের দুয়ার খুলে বসে থাকেন সুফিয়ান। দর্শনার মোবারকপাড়ার এক আতœীয়ের দয়ায় তাদের বাড়ির ছোট্ট একটি টিনশেড কক্ষে স্ত্রী সেলিনা আক্তার কনক আর ৭ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মাওয়া ও ১৪ বছরের ছেলে আবু সাইফ কাসফাতকে নিয়ে সুফিয়ানের সংসার।
আশির দশকের অক্টোবরে এক দল সমাজকর্মীর উদ্যোগে বাংলার প্রাচীন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) থেকে শুরু হয় গণগ্রন্থাগার সিডিএলের আনুষ্ঠানিক পথচলা। ‘জ্ঞান হোক শোষিত মানুষের মুক্তির
সহায়ক’ এ ¯ে¬াগানের সামনে নিয়ে ১৯৮৯ সালে নিশান উড়িয়ে সারাদেশের মতো দর্শনাতেও আবু সুফিয়ানের তত্ত্বাবধানে ভাড়া করা একটি টালি ঘরে শুরু হয় গ্রন্থাগারটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা। সারাদেশে এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি দর্শনা গণগ্রন্থাগার।
দৃঢ় প্রত্যয়ের আবু সুফিয়ান ও সেলিনা আক্তার কনক বন্ধ হতে দেননি পাঠাগারটি। সিডিএল কর্তৃপক্ষের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের আওতায় পাঠাগারটির যাত্রা শুরু হলেও নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ দিত তারা। বাকি সব খরচই বহন করতে হতো উদ্যোগী ও ত্যাগী আবু সুফিয়ানকে। এক সময় গ্রন্থাগারটি চালাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন আবু সুফিয়ান, তখন নীরবে তার পাশে এসে দাঁড়ান সেলিনা আক্তার কনক। যে পাঠাগার মানুষকে আলোর পথ দেখায়, যে বই মানুষকে উদার ও মানবিক হতে শেখায়, এমন একটি বাতিঘর বন্ধ হয়ে যাবেথ সেটা কিছুতেই মানতে পারেন না সুফিয়ান ও কনক। পাঠাগার ও বই তাদের কাছে সংসার এবং সন্তানের মতোই সমান প্রিয় ও পবিত্র। একদিন পাঠাগারের পত্রিকার বিল না দেওয়ায় এজেন্ট বকেয়ার দায়ে পত্রিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারেন না সেলিনা আক্তার কনক। নিজের সন্তানের মাসকাবারি দুধের টাকা দুধওয়ালাকে না দিয়ে পাঠাগারের পত্রিকার বিল পরিশোধ করেন কনক। এতে দুধওয়ালা টাকা না পেয়ে ছেলের দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সন্তান অভুক্ত থাকলেও ক্ষতি নেই, পাঠক যেন জ্ঞান আহরণে কিছুতেই অভুক্ত না থাকে। এক সময় সিডিএল কর্তৃপক্ষ ঘর ভাড়াও বন্ধ করে দেয়। পাঠাগারটি নিয়ে এবার যেন অথৈ সমুদ্রে পড়ে যান আবু সুফিয়ান। আবারও পাশে এসে দাঁড়ালেন সেলিনা আক্তার কনক। বিয়ের সময় অনেক কষ্টে দেওয়া স্বামী আবু সুফিয়ানের শ্রেষ্ঠ উপহার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি নিজ হাতের ৪০ হাজার টাকার এক জোড়া সোনার বালা মাত্র ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে গ্রন্থাগারটির নির্মাণ কাজ শুরু করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন কনক।
কীভাবে সমাজকে আলো বিলাতে হয়, তার যেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পোড় খাওয়া, আতœপ্রত্যয়ী বইপ্রেমী নারী কনক। যারা রাজনীতি, সমাজনীতির পসরা সাজিয়ে দেশটাকে উল্টে-পাল্টে
শোষণ করেন, তাদের জন্য কনক যেন বড্ড এক লজ্জার নাম।বর্তমানে স্থানীয় সরকারি কলেজের উত্তর-পূর্ব কোনায় চটকাতলার পাশে ছায়া সুনিবিড় নির্মল পরিবেশে টিনের দোচালা ঘরটি নিজেদের টাকায় ও শ্রমে নির্মাণের পর, সেটি নির্মল পরিবেশে পাঠকের পদভারে মুখরিত থাকে সব সময়।
বর্তমানে কিছু স্থায়ী সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে গ্রন্থাগারটি আবারও মাথা তুলে দাড়াতে চাই।অসংখ্য পাঠকের কথা ভেবে আবু সুফিয়ান  গ্রন্থাগারটিকে টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কিন্তু এভাবে কতদিন । একটি সময় হয়ত আবু সুফিয়ান থাকবে না, তখন কি থাকবে আমাদেও এই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগারটি। ভাবতে গেলে বুকে কান্ন্া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আবুসুফিয়ান এসব নিয়ে ভাবতে চান না। তিনি চান সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।