ডেস্ক,২ জুন: ঢাকার ২৫৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ৩১টিতে দখলদারদের থাবা পড়েছে। এগুলোর ভবন, জমি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন কমিউনিটি সেন্টার, গ্যারেজ, দোকান, ক্লাবঘর, বস্তি, কাঁচাবাজারসহ নানা প্রতিষ্ঠান। দখলের তালিকায় ঢাকা ওয়াসাও রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর ১০ম জাতীয় সংসদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজধানীর প্রাথমিক স্কুলের জমি অথবা ভবন দখলমুক্ত করতে ৫ সদস্যবিশিষ্ট ৩ নম্বর সাব কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন পরিদর্শন করে ওই বছরই কয়েকটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেসময় কমিটি দখলকৃত ৪৮টি বিদ্যালয়ের জমি ও ভবন উদ্ধারের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং ঢাকার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে (ডিপিইও) দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েকটিতে উদ্ধারের তৎপরতা চালালেও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে পুরান ঢাকার বেগমবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও দখলদারদের কবলে পড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাজিম জানান, আমরা আগে স্কুলটির খোঁজ-খবর রাখতাম। এরপর ছেড়ে দিলে তা বেহাল অবস্থায় চলে যায়। সেখানে কাউন্সিলরের অফিসসহ নানা কার্যক্রমের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, এর আগে বেদখল হয়ে যাওয়া স্কুলগুলোর মধ্যে রাজধানীর কাপ্তানবাজারের খোদাবক্স সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা বেশ পুরনো। স্কুলটি বন্ধ করে দিয়ে ছাগলের হাট আর পশু জবাইখানা বানানো হয়েছে। পুরান ঢাকার ওয়ারির যোগীনগর রোডে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলেরও ১১ শতাংশ জমির মধ্যে ৫ শতাংশই দখল হয়ে গেছে। দখল করা জমিতে উঠেছে পাঁচতলা একটি ভবন। ১৯৬৩ সালে চকবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় ছোট কাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরবর্তীতে মিটফোর্ড এলাকায় দোতলা একটি পরিত্যক্ত বাড়ির নিচতলায় বিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলে। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দৈন্যদশায় পড়ে আছে বাবুবাজারের হয়বত্নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছোট কাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সূত্রাপুর থানাধীন ২২ নাম্বার বনগ্রাম রোডে ছিল ইসলামিয়া ইউ.পি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখন সেটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ সুনসান। সেখানে কারও আনাগোনা নেই। স্থানীয় কয়েকজন ওই ভবনের কক্ষে মালামাল রাখার জন্য গোডাউন বানিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আরমানিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮.২ শতাংশ জমির মধ্যে ৫.৬ শতাংশ জমি নিজ নামে নামজারির মাধ্যমে দখল করেছেন সাবেক প্রধান শিক্ষক।
নাজিরাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি কক্ষ নাজিরাবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় দখল করে মালপত্র রেখেছে। কোতোয়ালির হাজী মাজহারুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ আনসার বাহিনী দখলে রেখেছে। গোয়ালনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি ১৯৯০ সাল থেকে স্থানীয় এক হাইস্কুলের নামে দখল হয়ে গেছে। গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫.৭৬ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে খেলাঘরের স্থানীয় শাখা। শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২.৩ শতাংশ জমি দখল করেছে শহীদ নবী উচ্চ বিদ্যালয়। বিপিনী রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের ভিতরে একটি ক্লাবের কার্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল নিয়ে আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে মামলা এখনো চলমান। গেণ্ডারিয়ার ঢালকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি নিয়েও মামলা চলছে। শিশুরক্ষা সমিতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নতুন করে জাতীয়করণ হলেও স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটি এ বিদ্যালয়ের ১৬ শতাংশ জমি দখল করে ঘর বানিয়েছে। ডেমরার ব্রাহ্মণচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট জমির পরিমাণ ৩৯ শতাংশ। বিদ্যালয়ের মূল ভবন বাদে ৩১ শতাংশ জায়গাই বেদখলে। মোহাম্মদপুরের টাউন হল সংলগ্ন ৩৬ শতাংশ জায়গার ওপর ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহীন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের ৩৬ শতাংশ জায়গার মধ্যে ৩১ শতাংশই দখল হয়ে গেছে। কামরাঙ্গীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪২ শতাংশ জমির মধ্যে সাড়ে ১০ শতাংশ বেদখলে। শেরেবাংলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৯৬ শতাংশ জায়গার মধ্যে ৩৩ শতাংশের ওপর চোখ পড়ে দখলদারদের। সেখানে বস্তি বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
মিরপুরের কাজী ফরিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক একর ৮৫ শতাংশ জমি থাকলেও বিদ্যালয় ভবনের কয়েক শতাংশ জমি বাদে পুরোটাই বেদখলে। ১৯৬২ সালে বেইলি রোডে প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক শিক্ষাকেন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের চার কাঠা জায়গা বেদখলে। পুরান ঢাকার প্যারিদাস রোডে একটি বাড়িতে ১৯৭০ সালে বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ভবনও দাতার স্বজনদের দ্বারা বেদখলে। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নাজিরাবাজার সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়। কিন্তু এখন স্কুলের ১০ শতাংশ জায়গার প্রায় পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার বংশালের এফ কে এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনের তিনটি তলাই দখল করে রেখেছে বংশাল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সুরিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের মধ্যে একটি দখল করে নিয়েছে ‘রমনা রেলওয়ে’ নামের একটি বেসরকারি স্কুল। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গুলশানের কাচকৃঢ়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করেছে কাচকৃঢ়া ডিগ্রি কলেজ কর্তৃপক্ষ। তিনটি ভবনের মধ্যে দুটিই তাদের দখলে। মিরপুরের হাজী ইউসুফ আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের ইট, বালু, সুরকিসহ নির্মাণসামগ্রী রাখার স্থানে পরিণত হয়েছে। মিরপুরের দারুসসালাম রোডে গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আবদুল মান্নান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও কিছু জায়গা দখলদারদের থাবায়। পল্লবীর বালুমাঠ এলাকায় বনফুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছে। মোহাম্মদপুরে সাতমসজিদ রোডে বরাবো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ জমি দাতার স্বজনদের দখলে। মাতুয়াইলে পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২১ শতাংশ জমি বেদখলে। মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গায় মতিঝিল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাচীর নির্মাণ করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা উচ্চ বিদ্যালয়ের দখলে চলে যায়। মিরপুরের শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ জমিতে রয়েছে ওয়াসার পাম্প। ধানমন্ডি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৬ শতাংশ জমির মধ্যে ৩০ শতাংশ দখল করে বসানো হয়েছে ওয়াসার পাম্প। এই বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণিতে পরিচালিত হয় ধানমন্ডি ল’ কলেজের কার্যক্রম।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাহিদুর রহমান বিশ্বাস বলেন, সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোতে নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড করলেও অনেক সরকারি বিদ্যালয় রয়ে গেছে উন্নয়ন ছোঁয়ার বাইরেই। রাজধানীর মিরপুরে শেখ কামাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তার সাথেই লম্বা সারিতে কয়েকটি কক্ষ। স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পরিবেশ। উপরে টিনের ছাপড়া। সেগুলোতেও মরিচা পড়া। স্কুলের কক্ষ পেরোলেই সামনে মূল সড়ক। এমনই চিত্র রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ সরকারি বিদ্যালয়টির।
খেলাধুলার জন্য মাঠ দুরে থাক স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থাও নেই এ বিদ্যালয়ে। এছাড়াও রাজধানীর অনেক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর বেহাল দশা। অমনক প্রাথমিক বিদ্যালয় নানা সমস্যায় জর্জরিত। অমনকগুলোতে শিক্ষকের প্রচণ্ড সংকট। সরকারি প্রাথমিক স্কুল উন্নয়নে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। সরকারি প্রাথমিকে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে পড়ান না। অভিভাবকদের এ মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। কারণ প্রাথমিকে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছে।
সূত্রমতে, ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। রাজধানীর বস্তিবাসী, ছোট দোকানি, সিএনজি চালক, গৃহকর্মী, কাজের বুয়া, রিকসা চালকসহ অন্যান্য নিম্ন আয়ের মানুষেরাই তাদের সন্তানকে ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পাঠাচ্ছেন।
সুত্র: দৈনিক শিক্ষা