ডেস্ক: খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানোর প্রবল ইচ্ছেটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন দুঃখী মানুষের কাতারে। কখনো বা রাজনীতির মাধ্যমে মানবসেবায় নিজেকে উজাড় করে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে। ধীরে ধীরে বড় হওয়া। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু মাতৃতুল্য এ বিদ্যাপীঠ থেকে।
অপশক্তিকে রুখে দিয়ে বিজয়ের কেতন উড়িয়ে একদিন বাঙালি নেতৃত্ব দেবে বিশ্ব দরবারে- এমন স্বপ্নই তাড়া করতো। অথচ যে বিদ্যাপীঠ প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে, সেখান থেকেই হয়েছেন আজীবনের জন্য বহিষ্কার! অপরাধ- চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী ইউনিয়নের কয়েকটি দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। বহিষ্কৃত হলেও তাতে কী? নিজেকে আর থামিয়ে রাখেননি। দেশ মাতৃকার জন্য লড়েছেন অবলীলাক্রমে। এক সময় তাঁর সাহসী নেতৃত্ব বাঙালিকে এনে দেয় লাল সবুজের একটি পতাকা। বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভাব ঘটে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ।
বহিষ্কৃত হয়েও প্রিয় প্রতিষ্ঠানের কাছে ছিলেন চিরঋণী। কারণ এ বিদ্যাপীঠই তাকে শিখিয়েছে কীভাবে বাতিলকে রুখে দিতে হয়। কৃষক শ্রমিক মানুষের পক্ষে সোচ্চার হতে হয়। তাইতো স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দিয়ে ঋণের বোঝাটা কিছুটা হালকা করবেন এমন প্রত্যাশা। কিন্তু ঘাতকরা সে ঋণ শোধ করতে দিল না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বুলেটের আঘাতে জাতির পিতার সব স্বপ্ন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে বাঙালি আজ বিশ্বময় নিজেদের জানান দিচ্ছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে শক্ত অবস্থান দাঁড় করিয়েছে। অথচ অপূরণীয়ই রয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সে মর্যাদা দেয়ার ইচ্ছে করলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সঙ্গে এক আলাপকালে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্ত কবে নাগাদ দেয়া হবে? জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হিসেবে পারবেন তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাকি আবারো নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়বে?
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আশা করেন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ মর্যাদা পাবে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন বিশেষ মর্যাদা দিতে পারতেন, তাহলে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব দরবারে বিশেষ অবস্থানে চলে আসতে পারতো।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কোনো আচার্য হিসেবে আগমনের কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। পরিদর্শনে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (বিশেষ মর্যাদা) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন। কারণ সে সময় বাংলাদেশে কোনো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাই দেশ শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠকে এ মর্যাদা দেয়ার ইচ্ছের কথা আগেই জানালেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন সে লক্ষ্যে ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ১৪ আগস্ট বিকেলের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) বক্তব্য রাখবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্য লেখা হয়েছে মানপত্রও। এদিন এ মানপত্র পড়বেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বঙ্গবন্ধুকে সমস্যার কথা জানাতে চেয়েছিল। মানপত্রটিতে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পূর্ব ঘোষণার কথাও উল্লেখ ছিল। পাশাপাশি বলতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের সমর্থনের কথা। প্রত্যাশামাখা মানপত্রটির সমাপ্তি টানা হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ দিয়ে।
কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে সেই মানপত্র বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার আগেই ঘটে গেছে ইতিহাসের এক কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞ। ওইদিন ভোরে সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাড়িতে খুন হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের প্রায় সব সদস্য।
এ বিষয়ে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্র তাওহীদ ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দিতে পারতেন তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর এগিয়ে যেতো। স্বাধীনতার এতো বছর পরও বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক।
বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশটিকে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম নজর দেন শিক্ষাখাতে। যার জন্য তিনি দেশে প্রাথমিক শিক্ষার খরচ সরকারের দায়িত্বে নিয়ে আসেন। এরপর হাত দিতে চেয়েছেন উচ্চশিক্ষায় যার প্রথম হিসেবে শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার সময়ও উচ্চশিক্ষার আলো ছাড়িয়েছে সাফল্যের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ দেখাতেও বলেছিলাম, যে বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন আসতে পারতেন তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ মর্যাদা পেয়ে যেতো। তিনিও আশ্বস্ত করেছিলেন। কারণ বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। পুরো জাতির স্বপ্ন ও প্রত্যাশা যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ মর্যাদা পাক। প্রধানমন্ত্রীর সাপোর্ট আছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। তাছাড়া বর্তমান মন্ত্রিসভারও প্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। প্রশাসনেও ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যক্তি ঢাবির শিক্ষার্থী। তারপরও অজানা কারণে হচ্ছে না। কে শোনে কার কথা। এটি বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই তো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দেয়ার কথা ছিল। যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে তৎকালীন ভেতরকার কিছু লোক জাতিকে বিভ্রান্ত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে আলাদা একটা নাম রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিন্ন হবার নয়। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করেছিল। যেটি আমরা পরবর্তীতে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে লেখা মানপত্রটিও প্রধানমন্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করেছি। তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক অটুট থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা দিতে। যদি সে মর্যাদা দিতে পারতেন তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব দরবারে বর্তমানে আরো ভালো অবস্থানে চলে যেতো।
source: jagonews