কে. এম. মুহতাসিম সাদিক তানিম: এবারে রাজধানীর নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছেন। এরপর তিনি শুরু করেন ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি প্রস্তুতি। স্কুল জীবন থেকে পড়াশোনায় বেশ সাফল্য রয়েছে তানিম। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন তিনি। একাধারে পেয়েছেন ডেন্টাল, মেডিকেল ও প্রকৌশল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় শীর্ষস্থান।
তানিম এখন পর্যন্ত একাধিক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কয়েকটির ফলাফল ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার ফলে তিনি প্রথম হয়েছেন, মেডিকেলে হয়েছেন ১৫তম আর প্রকৌশল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছেন ২১তম।
তানিমের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার ভেড়ভেড়ীতে। তার বাবার মো. ইস্কান্দার মির্জা। মা মোছা. লিলিফা বেগম। তার বাবা চাঁদেরহাট ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং মা কিশোরগঞ্জের শিশু নিকেতন স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষিকা।
স্থানীয় সোনামণি আইডিয়াল স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন তানিম। এরপর সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে মাধ্যমিক শেষ করেছেন। এরপর চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। নটর ডেমের ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন তানিম।
স্কুলকলেজ জীবনেও বেশ সাফল্যমণ্ডিত ছিল তানিমের জীবন। তিনি বলেন, স্কুল লাইফ থেকেই চেষ্টা করতাম একাডেমিকের বাইরেও গল্পের বই, প্রোগ্রামিং, অলিম্পিয়াড এসব করার। পরবর্তীতে এগুলোতে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছি।
শিক্ষা জীবন নিয়ে তানিম বলেন, করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার পরপরই আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। আমি পরীক্ষার ৩টি বিষয়েই ফুল মার্ক পাই (গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন)। এরপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হই। আমি কখনো ঘণ্টা ধরে পড়তাম না। মূলত একটি ছোট টার্গেট নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সেটুকু পড়ে শেষ করতাম। তবে চেষ্টা করতাম সর্বোচ্চ সময়টুকু পড়াশোনার কাজে লাগানোর।
গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য রাজধানী ঢাকায় এসে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তানিমকে। দীর্ঘ সময় লড়াই করেছেন অসুস্থতার সঙ্গে। সে অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, তখন আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে ঢাকায় আসা, অচেনা পরিবেশ, নতুন বিদ্যালয়…। কিন্তু একটাই স্বপ্ন, ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেতে হবে। এরপর থেকেই শুরু শারীরিক সমস্যা।
‘‘ল্যারিনজাইটিস, জ্বর, টাইফয়েড। এরপর কলেজের ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার সময় আলসার পেইন শুরু হয়। যেটা এক্সামের পর ধরা পড়ে এন্ডোস্কোপিতে। অথচ এন্ডোস্কোপি এত কষ্টের যে কম বয়সের রোগীকে সাধারণত দেয়া হয় না। ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) ডিওডেনাল আলসার ছিল। তবে, ডাক্তার আমাকে মোটিভেট করেছিলেন। আমিও জানতাম সারতে সময় লাগবে, তবে উনার কথায় আমি সাহস পেয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে থাকি আবার।’’
ডাক্তারের এমন সৎ পরামর্শ বেশ মনে ধরেছে তানিমের। তিনি বলেন, তখনই আমি বুঝতে পারি, একজন ডাক্তার আসলে একটি অসহায় মানুষের অনেক ভরসার একটি জায়গা। আমার সেসময় চিকিৎসক ছিলেন ডা. ফরহাদ-উল-হাসান ও ডা. দেবাশীষ রায়। তাদের কথাই যেন আমার অসুখ অনেকটা সারিয়ে দিয়েছিল। আমিও তাই ভেবে নিই, ডাক্তারই হব। একজন মানুষকে সুস্থ করতে পারলে তার মন থেকে যে দোয়া-ভালোবাসা পাওয়া যায় তা আর অন্য পেশায় সম্ভব নয়।
ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন তানিম। তিনি বলেন, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা ছোটবেলা থেকেই। দেখতাম বইয়ের পাতায় আলাদা একটা পেশা হিসেবে চিকিৎসক লেখা থাকত। হয়তোবা তখন সাদা অ্যাপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ বেশি আকর্ষণ করেছিল। পরবর্তীতে আব্বু-আম্মুও মোটিভেট করতো। কিন্তু এটার প্রতি আসল ভালোবাসা তৈরি হয় ইন্টার লাইফে। আমি আমার সকল শিক্ষকদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তারা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।
মেডিকেলে ভর্তি প্রস্তুতির অভিজ্ঞতা জানিয়ে তানিম বলেন, আমি মূলত পড়ার মাঝে গ্যাপ দিয়ে পড়তাম। পোমোডোরো টেকনিক বলে এটাকে। এতে ফোকাস ধরে রাখা যায়। আর সবকিছু বুঝে, একটার সাথে অন্যটা মিল-অমিল খুঁজে এমনভাবে পড়তাম যেন আমি বিষয়টি আরেকজনকেও বোঝাতে পারি। এতে আমার মনে যেমন একটি প্রশান্তি কাজ করতো, বিরক্তিও আসতো না। পড়াটাও বেশিসময় স্মরণে থাকতো। একে বলা হয় ফাইনম্যান টেকনিক। আমি মনে করি, সবার ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগবে।
একাধিক প্রতিষ্ঠানে চান্স পেলেও তিনি মেডিকেলেই ভর্তি হতে চান। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তানিম বলেন, আমি একজন নিউরোসার্জন হতে চাই। এটি জটিল বিষয় হলেও মানবমস্তিষ্কের রহস্য জানতে আমার ভালো লাগবে আশা করি। আমি চাই, আমার এলাকার এবং সর্বোপরি দেশের সকল মানুষের নিকট একজন ভালো ও মানবিক চিকিৎসক হতে। ডা. কামরুল হাসান স্যারের বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন আমাকে অনেক উৎসাহিত করেছে। আমিও তার মতো গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করতে চাই নিজের মেধা, দক্ষতা ও শ্রম দিয়ে।