নিজস্ব প্রতিবেদক,২০ অক্টোবর ২০২১ঃ
সারা দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ৯-৩-১৪ হতে ১৪-১২-২০১৫ খ্রিঃ পর্যন্ত টাইমস্কেল পেলেও একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক প্রধান শিক্ষকদেও মধ্যে হতাশা ও ক্ষেভের সঞ্চার হয়েছে।
সুত্র জানায়,অর্থ বিভাগের ০৪/১২/২০১৩ তারিখের ২৮৩ নং পত্রের সম্মতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১৩তম গ্রেড থেকে ১১তম ও ১৪তম গ্রেড থেকে ১২ তম গ্রেডে উন্নিত করা হয়। একইসাথে তাদের পদমর্যাদা ৩য় শ্রেণি থেকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়। বেতন গ্রেড উন্নীত হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষকগণ ০৯/০৩/১৪ হতে ১৪/১২/২০১৫ সময়ের টাইমস্কেল পাচ্ছেন না।
আরো পড়ুনঃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টাইম স্কেলের ‘ফাঁদে’ ৪১০০ প্রধান শিক্ষক
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৬০১। এসব স্কুলে প্রধান শিক্ষক রয়েছেন ৫৫ হাজারের মতো। অন্য সব স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয় রয়েছে ২৬ হাজার। ২০০৩,২০০৬,২০০৭ সালে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছেন ৪০০০ এর কাছাকাছি যারা ১ম এবং ২য় টাইমস্কেল বঞ্চিত। জাতীয়করণ প্রধান শিক্ষক বাদে বাকি ৩০ হাজার প্রধান শিক্ষক টাইমস্কেল পেয়েছেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার সহস্রাধিক প্রধান শিক্ষক তাদের প্রাপ্য টাইম স্কেল না পেয়ে হতাশ। একটি টাইম স্কেল পেলে একজন প্রধান শিক্ষকের বেতন এক ধাপ (গ্রেড) ওপরে যায়। ২০১৫ সালে সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরের পর থেকে টাইম স্কেল উঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এসব শিক্ষকের পাওনা তার আগের। এ বাবদ সরকারের কাছে তাদের পাওনা হয়েছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
শিক্ষকরা বলেন গত ১৫/১১/২০১৭ ইং তারিখে প্রধান শিক্ষকদের উন্নিত বেতনস্কেলের জটিলতা নিরসনের জন্য অর্থ মন্ত্রনালয় কর্তৃক একটি পত্র ইস্যু করা হয়েছে। যার স্বারক নং ০৭.০০.০০০০.১৬১.৩৮.০০.০০১.১৭-২০১। পদোন্নতি ব্যতিত একই পদে থাকলে উচ্চতর গ্রেড/টাইমস্কেল পাবার বিধান থাকলেও অজ্ঞাত কারনে আমরা সকল সরকারী কর্মচারীর ন্যায় টাইমস্কেল/উচ্চতর গ্রেড থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ০৯/০৩/২০১৪ খ্রিঃ প্রধান শিক্ষকগণ ২য় শ্রেণি হয়েছেন ঠিক। কিন্তু প্রধান শিক্ষকগণ তৎসময় (অর্থাৎ ০৯/০৩/২০১৪ খ্রিঃ) পদোন্নতি পেয়ে সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার হয়নি। তবে শ্রেণি উন্নয়ন হয়েছে বটে। শ্রেণি উন্নয়ন আর পদের উন্নয়ন (পদোন্নতি) কখনও এক হতে পারে না।
উত্তর পূর্ব চর লামছিপাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বরিশাল বিভাগের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ মন্ডল বলেন, প্রধান শিক্ষক পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়া হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য কোন সুবিধা অদ্যবধি প্রাথমিকের কোন প্রধান শিক্ষক পাননি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোন গেজেটও জারী করা হয়নি। বরং ঘোষণাটির ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
পঞ্চগড় জেলার দেবিগঞ্জের কালিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ১৫/১১/২০১৭ ইং তারিখে প্রধান শিক্ষকদের উন্নিত বেতনস্কেলের জটিলতা নিরসনের জন্য অর্থ মন্ত্রনালয় কর্তৃক একটি পত্র ইস্যু করা হয তা সংশোধন করে ১৪/১২/২০১৫ পর্যন্ত টাইমস্কেল সকল প্রধান শিক্ষক টাইমস্কেল পাবার জোর দাবী করছি।
রাঙামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি রঞ্জিত ভট্টাচার্য মনি বলেন, প্রধান শিক্ষক পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা এখনও কোনো প্রধান শিক্ষক পাননি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো গেজেটও জারি করা হয়নি। বরং ঘোষণাটির ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রধান শিক্ষকরা।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির খুলনা বিভাগীয় সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধান শিক্ষকদের উন্নীত বেতন স্কেলের জটিলতা নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠি মোতাবেক উচ্চতর গ্রেড/টাইম স্কেল পাওয়ার বিধান থাকলেও অজ্ঞাত কারণে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষকরা শুধু মর্যাদা পেয়েছেন, পদোন্নতি পেলে তো তারা সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হতেন।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সিনিয়ার যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও টাইমস্কেল বঞ্চিত কমিটির আহবায়ক স্বরুপ দাস বলেন ,শিক্ষকদের ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও প্রধান শিক্ষক পদটি ব্লক পদ। এ পদ থেকে পদোন্নতির কোন সুযোগ নেই। অথাৎ ৯/৩/২০১৪ হতে তাদেও শুধুমাত্র গ্রেড ও পদমর্যাদা উন্নীত হয়েছে। কোন পদোন্নতি হয়নি। পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়োগবিধির শর্ত প্রতিপালন করে পদোন্নতি হয়ে থাকে। এজন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি/পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশ প্রয়োজন হয়। আর গ্রেড আর পদমর্যাদা উন্নীত হয় নির্বাহী আদেশে। কাজেই প্রধান শিক্ষক পদটি ২য় শ্রেণিতে উন্নিত হলেও কোন পদোন্নতি হয়নি। তাই আমাদের টাইমস্কেল দিতে কোন বাধা থাকার কথা না।
ইতিমধ্যে গত ৩-৬-২০২১ খ্রিঃ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় আমাদের প্রধান শিক্ষক পদটিকে ননগেজেটেড হিসাবে ঘোষনা করার পর প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উপসচিব ডঃ মোঃ মাহমুদুল রশীদ স্বাক্ষরিত পত্রে প্রয়োজননীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন যা টাইমস্কেল পেতে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে।
টাইমস্কেল প্রাপ্তির বিষয়ে চাকরি আদেশ ২০০৯ এর অনুচ্ছেদ ৭(১)এর বিধান নিম্নরুপ-
জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ এর টাকা ৪১০০-৭৭৪০(২০ নং গ্রেড)হইতে টাকা ৮০০০-১৬৫৪০/-(১০নং গ্রেড) বেতনবিশিষ্ট পদের আওতাভুক্ত নন-গেজেটেড সরকারি কর্মচারিগণ একই অথবা সমপর্যায়ের পরস্পর বদলিযোগ্য পদে ৮,১২,১৫ বৎসর চাকুরি পূর্তি এবং চাকুরির সন্তোজনক রেকর্ডের ভিত্তিতে যথাক্রমে ১ম,২য় ৩য় পরবর্তী উচ্চতর বেতনস্কেল বা টাইমস্কেল হিসাবে প্রাপ্য হবেন।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন,গত ৫ জানুয়ারী ২০২১ খ্রিঃ মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ উপসচিব মোঃ সাজ্জাদুল হাসান স্বাক্ষরিত পত্রে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ে সচিব মহোদয়কে পুণরায় ব্যবস্থা গ্রহনের অনুরোধ জানানো হলেও এখনও সেটার কোন সমাধান আমরা পাইনি।
জাতীয় বেতন স্কেল সর্বশেষ ঘোষিত হয় ২০১৫ সালে। এর আগে সরকারি কর্মচারীবৃন্দ ৩ টি টাইম স্কেল পেতেন। এখন সেই টাইমস্কেল নাম পরিবর্তন করে উচ্চতর গ্রেড / সিলেকশন গ্রেড ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়। আগে সমগ্র চাকুরী জীবনে কোন চাকুরীজীবী তিন বার এটি প্রাপ্ত হলেও এখন পান ২ বার। ১০ ও ১৬ তম বছর শেষে।
এই টাইমস্কেল/সিলেকশন গ্রেড বা উচ্চতর গ্রেড যে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন এটি প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের নির্দেশনা হল ঃ
‘একই পদে কর্মরত কর্মচারী কোন প্রকার উচ্চতর স্কেল (টাইমস্কেল)/সিলেকশন গ্রেড (যে নামেই অভিহিত হউক) না পাইয়া থাকিলে সন্তোষজনক চাকরির শর্তে তিনি ১০(দশ) বৎসর চাকরি পূর্তিতে ১১তম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড এবং পরবর্তী ৬ বছরে পদোন্নতি না পাইলে ৭ম বছরে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্য হইবেন।’যেহেতু আমাদের পদের কোন পরিবর্তন হয়নি তাই আমাদের অধিকার সকল সরকারি কর্মচারির ন্যায় আমাদেরকেও ৯/৩/১৪ হতে ১৪/১২/১৫ পর্যন্ত আমাদের টাইমস্কেল দিতে হবে।
উল্লেখ্য প্রধান শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর সাথে একমত পোষণ করে তাদের টাইমস্কেল প্রদানে ব্যাখ্যাসহ সম্মতির জন্য গত ২৯ সেপ্টেম্বর অর্থ বিভাগে পত্র প্রদান করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু অর্থমন্ত্রনালয় ৯/৩/১৪ ইং তারিখে ২য় শ্রেণিতে উন্নিত হয়েছে এবং তা পদোন্নতি হিসাবে গণ্য করে টাইমস্কেল দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট-১) সিরাজুন নূর চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের টাইমস্কেল জটিলতা নিয়ে আমরা আবার আলোচনায় বসব। তারপর বলতে পারব তারা প্রাপ্য কিনা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলম মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, কেবল প্রাপ্যই নয়, এটা এই শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা। আমি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকাকালে এই প্রাপ্য তাদের দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি লিখেছি। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি। এখনও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছি।