চুয়াডাঙ্গা-দর্শনার প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে ব্যস্ত একাধিক শিক্ষক নজরদারিতে

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ৬০ শিক্ষকের মধ্যে ৪২ জনই নিয়ম ভেঙে প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। বিদ্যালয়ে পাঠদানে মনোযোগী নন তাঁরা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাঁদের তালিকা তৈরির পর জেলা প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। তারা ওই শিক্ষকদের নজরদারিতে রেখেছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাইভেট ও কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের সতর্ক করা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ নিয়ম ভাঙেন, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে প্রাইভেট পড়ানো ও কোচিং-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটা নীতিমালাও তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু তার তোয়াক্কা করেন না বেশির ভাগ শিক্ষক।
চুয়াডাঙ্গার ভি জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ দুটি বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষককে দেখে মনেই হয় না তাঁরা স্কুলে চাকরি করেন। তাঁরা সর্বদা ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট-কোচিং নিয়ে। এসব শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীরা সাজেশন থেকে বঞ্চিত হয় ও পরীক্ষায় তাদের কম নম্বর দেওয়া হয়। যারা প্রাইভেট পড়ে, তাদের সাজেশনের নামে আগাম প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষায় দেওয়া হয় বেশি নম্বর।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রভাতি পালার চতুর্থ শ্রেণির এ ছাত্রীর অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, এই শ্রেণির সর্বশেষ অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। ওই পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী বেশি নম্বর পেয়েছে, তাদের কয়েকজনের খাতা নিরীক্ষা করলেই বিষয়টি ধরা পড়বে।
শিক্ষকদের বিষয়ে ওই তালিকা তৈরি করেছে একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা। তালিকাটি জেলা প্রশাসনকে সরবরাহ করা হয়েছে। তালিকা মোতাবেক ভি জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে দুই পালায় প্রধান শিক্ষকসহ মোট ৩৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে প্রভাতি পালার ১২ ও দিবা পালার ১২ জন প্রাইভেট ও কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত। অন্যদিকে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ দুই পালায় ২৬ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে প্রভাতি পালার আট ও দিবা পালার ১০ জন শিক্ষক এতে জড়িত।
সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী, একজন শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। তবে ওই ১০ জনের তালিকা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠানকে লিখিতভাবে দিয়ে তার অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার ওই শিক্ষকদের একজনও এ নিয়ম মানছেন না। তাঁরা কমপক্ষে ৩০ থেকে শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন। এ ছাড়া অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বল শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের কোচিংয়ে পড়ানোর সুযোগ থাকলেও সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। এমন কোচিং থেকে উপার্জিত অর্থের ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা দেওয়ার কথা। তারও তোয়াক্কা করেন না শিক্ষকেরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভি জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন বলেন, প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে পাঠদানের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের জানানো হয়েছে। সবাই দাবি করছেন, তাঁরা প্রাইভেট পড়ান না বা কোচিং করান না। চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার মালাকার একই কথা বলেন।
গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি প্রতিবেদনটি হাতে পাওয়ার পর গত ২২ জুলাই চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও কোচিং সেন্টারের পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ১০ দফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সাধারণ ক্লাস ও ব্যবহারিক ক্লাস নিশ্চিত করা; ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের আগমন ও প্রস্থানের বার্তা অভিভাবককে প্রেরণ; শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাসময়ে উপস্থিতি; শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ পরিপত্রের নির্দেশনা মেনে চলা; বিদ্যালয়ে পাঠদান প্রক্রিয়াকে কার্যকর করতে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া এবং স্কুল চলাকালে সব ধরনের প্রাইভেট ও কোচিং বন্ধ রাখা।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার বেশির ভাগই তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে নিয়মিত পেয়ে আসছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনটি পাওয়ার পর বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।
জেলা শিক্ষক-অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও ভি জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল মোত্তালিব প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকদের এখন আর আন্তরিকতা নেই। ক্লাসে নামমাত্র লেকচার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। এ অবস্থা চললে শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না।

এদিকে শুধু কোচিং না বিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে চলছে কোচিং বানিজ্য। ৫০০-১০০০ টাকা নিয়ে ৬ষ্ট থেকে ১০ শ্রেণি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়। যেখানে দূর্বল ছাত্রচাত্রীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানোর কথা সেখানে ক্লাসের ফাষ্ট বয় থেকে শুরু করে লাষ্ট বয় সবাই অতিরিক্ত ক্লাস করায় ব্যস্ত। সচেতন মহলের দাবি বিদ্যালয়গুলোতে সকল অতিরিক্ত ক্লাস বন্ধ করে শুধু বিদ্যালয়ের নিদিষ্ট ক্লাস মনোযোগ সহকারে পাঠদান করলে শিক্ষার মান যেমন বৃদ্ধি পেত তেমনি সকল অভিভাবক অতিরিক্ত অর্থ খরচ থেকে বাচত।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।