চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধীনে অন্তত ১০টি করে ২০টি সরকারি কলেজ দেয়া হচ্ছে। কলেজগুলো বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সরকারি কলেজকেও পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে দেয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এমন পদ্ধতিতে সাত বছর আগে ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে পরিচালনার জন্য দেয়া হয়েছিল। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই সাতটি কলেজে এখন পড়াশোনার মান বহুগুণে বেড়েছে। রীতিমতো পড়াশোনা করেই এই সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি অর্জন করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, এরই মধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এ সংক্রান্ত নথিতে সই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ওই জেলা দুটির কয়টি সরকারি কলেজকে পরিচালনার জন্য দেবে তা কয়েক দিনের মধ্যেই আদেশ জারি করে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে।
ওই কর্মকর্তার মতে, সরকারি কলেজগুলো সংশ্লিষ্ট জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করেই চলবে। সেক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল হিসেবে নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এতে সাত কলেজ পরিচালনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেসব সমস্যায় পড়তে হয়েছে, সেসব সমস্যায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পড়তে হবে না। তবে অনেক জেলার নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কিছু জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেখানে হয়তো পাশের জেলার বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নজরদারির দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজ চলে গেলেও তাদের অধিভুক্ত এক হাজার ৬৭৪ বেসরকারি কলেজ থেকে যাবে। শুধু পরীক্ষার দায়িত্ব না নিয়ে সেগুলোর সার্বিক দায়িত্ব যদি তারা নেয়, তাহলে তাদের শিক্ষার মান উন্নত হতে বাধ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের সব সরকারি কলেজ স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে দেয়ার জন্য অনুশাসন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১০ বছর আগে এই অনুশাসন দেয়া হলেও এতদিনে তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অধিভুক্ত কলেজের ভারে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার দিকে খুব একটা নজর দিতে পারেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় প্রতিনিয়ত তাদের আয় বেড়েছে। অবশেষে উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি কমানোর উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর আগে, প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের ফলেই কিছুটা দেরিতে হলেও রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত হয়। শুরুতে নতুন প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর ভার নিয়ে ঢাবি কর্তৃপক্ষ চাপে পড়লেও এখন সবকিছু অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে। কমিয়ে এনেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। নজর দিয়েছে শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে। এরই মধ্যে যার সুফল পেতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। বাড়ছে এই সাত সরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষার মান।
কিন্তু একই সময়ে দেশের অন্যান্য সরকারি কলেজও স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে যাওয়ার কথা থাকলেও তা কোনো কারণে আটকে যায়। সরকারি কলেজগুলোতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এত শিক্ষার্থী যাতে কোনোভাবেই ছুটে না যায়, সেজন্য অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি হতে দেয়নি সরকারি কলেজগুলোকে। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি থেকে মানের দিক দিয়ে তলানিতে ঠেকেছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েই গত জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ওই সময়ই সরকারি কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করে একাডেমিক মনিটরিংয়ের (শিক্ষার মানে নজরদারি) দায়িত্ব নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে শুরতেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট (স্নাতক) কোর্স চালু না করে সরকারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিতে বলেছেন মন্ত্রী।
এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেখানেও হয়তো চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা তা অতিক্রম করেছি। সাত কলেজের মান উন্নত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সাত কলেজে নজরদারির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার মান উন্নত করতে পারে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন করতে পারবে না।
এসব ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করতে হলে মন্ত্রণালয় তা করবে। শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যদের আরো বলেছিলেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সারাদেশের নন ফরমাল এডুকেশনের একাডেমিক মনিটরিংয়ের কাজটা করছে, তাহলে কেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম কলেজের একাডেমিক মনিটরিংয়ের কাজ করতে পারবে না। ১৯৯২ সালের আগে তো তারাই মনিটরিং করত। আগে যদি করার সক্ষমতা থেকে থাকে তাহলে এখন তো সক্ষমতা আরো বাড়ার কথা। মূলত শিক্ষামন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরই ১০ বছর আগে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নপর্ব শুরু হয়। গত দেড় মাস কাজের পর প্রথম ধাপে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জেলাগুলোর সরকারি কলেজ যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বাকি কলেজগুলোও দেয়া হবে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের ভোরের কাগজকে বলেন, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনার জন্য ১০টি করে সরকারি কলেজ যাওয়ার কথা। বাকিটা আদেশ পেলে বলতে পারব। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালনার জন্য সরকারি কলেজকে দেয়া হলে খুব একটা সমস্যা হবে না, বরং উচ্চশিক্ষার জন্য ভালোই হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়ে এখনো কোনো আদেশ পাইনি। তবে আদেশ পেলেও খুব একটা সমস্যা হবে। কারণ অনেক আগে এমন ব্যবস্থা ছিলো। অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চলের কলেজগুলোকে দেখভাল করত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর এই দেখভালের দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেয়া হয়। এখন আবার সরকার মনে করছে উচ্চশিক্ষার মানন্নোয়নে রাজশাহী জেলার কলেজগুলোকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করবে। সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ীই আমরা কাজ করব এবং এতে অবশ্যই উচ্চশিক্ষার মান উন্নত হবে।
জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা দুই হাজার ২৫৭টি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৮৩টি। তবে তার মধ্যে ৩৭৩ সরকারি কলেজে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। শুধু সরকারি কলেজে মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। সরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে এসব শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমে যাবে।
সরকারি-বেসরকারি কলেজ মিলিয়ে স্নাতক (পাস) পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ২১ জন। এর মধ্যে ছাত্রী আট লাখ পাঁচ হাজার ৭৮৮ জন। আর স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ছয় লাখ চার হাজার ৩০৩ জন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা এক লাখ ২৯ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫১ হাজার ৮৬৩ জন। এছাড়া সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৯ হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা সাত হাজার ৬৭৪ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে সারা বছরই কোনো না কোনো পরীক্ষা লেগে থাকে। আর অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এসব পরীক্ষার ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশনসহ নানা খাতে আদায়কৃত অর্থের বড় অংশই পায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও কলেজ পর্যায়ে যত্রতত্র উচ্চশিক্ষা চালু করলেও এর মানের দিকে তেমন একটা খেয়াল নেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের। তারা পরীক্ষার ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তবে তাদের তহবিলে জমা হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। আয়ের এসব টাকা তারা নিজেদের প্রয়োজন মতো খরচ করছেন।
বেসরকারি কলেজের তুলনায় সরকারি কলেজের সংখ্যা কম হলেও সরকারিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সমানে সমান। এখন সরকারি কলেজগুলো স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে গেলে আয়ে বড় ধরনের ছেদ পড়বে। এতে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে। তাই প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চায় সরকারি কলেজগুলো তাদের অধীনেই থাকুক।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কতটি সরকারি কলেজ যাবে সে বিষয়ে আগে থেকেই আলোচনা চলছিলো। এখন যাওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভাগ ভাগ করে কলেজগুলোকে পরিচালনার জন্য দিলে উচ্চশিক্ষার জন্য ভালোই হবে। ঢাকার পরে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি কলেজগুলোকে দেয়ায় অন্তত সংকট তৈরি হবে না। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারবে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কলেজগুলো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কম কিংবা বাড়ানোর কোনো বিষয় বিবেচনা করা উচিত নয়। আমাদের সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত, বাচ্চাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা।
তবে মশিউর রহমান এর আগে এক মন্তব্যে বলেছিলেন, সরকারি কলেজগুলো স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। তার মতে, সরকারি কলেজগুলো যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায় তাহলে তাদের আবার কলা, মানবিকের মতো বিভাগ খুলতে হবে। আবার যদি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায়, তাহলে তাদের বিজ্ঞানের বিষয় খুলতে হবে। এতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চরিত্র হারাবে। তবে চট্টগ্রাম, রাজশাহীর মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার এই সমস্যায় পড়তে হবে না। এখন একটা ব্যাপার হতে পারে, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবরেশন (দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা) বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। তাতে সবার স্ব স্ব অবস্থান বজায় থাকবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও হয়তো এ ব্যাপারে ভাবছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে কলেজগুলোর ভর্তি কার্যক্রম। প্রতি বছর স্নাতক পর্যায়ে এই কলেজগুলোতে ২১ হাজার ৫১৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। এই কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং সরকারি বাঙলা কলেজ।
জানা গেছে, সাত কলেজের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা একটি শাখা খুলেছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্যকে প্রধান সমন্বয়ক এবং কলেজগুলোর মধ্য থেকে একজন অধ্যক্ষকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর বাইরে একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করেই কারিকুলাম, সূচি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করা হচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। অন্যদিকে কমিয়ে আনা হয়েছে কলেজগুলোর আসন সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় দেশে কলেজের সংখ্যা কম ছিলো। তারপরও প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে ইউজিসির বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর পড়াশোনার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন আছে। ঠিকমতো ক্লাস না করে পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার অভিযোগ আছে। বাস্তবতা ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় না করেই দীর্ঘদিন ধরে ঢালাওভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কলেজে স্নাতক (সম্মান) চালু করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ কলেজেই উচ্চশিক্ষায় পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। শিক্ষার্থী ও কলেজের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সব কলেজকে ঠিকমতো দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আলোচনা আছে। ফলে এসব কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। এই অবস্থার মধ্যেও ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গাজীপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলো ইউজিসি।
ইউজিসির ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল ক্যাম্পাসে স্নাতক প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, মূল ক্যাম্পাসে স্নাতকে শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত আইনসংগত ও যথার্থ। এ নিয়ে টানাটানির মধ্যে ২০২৩-২৪ নতুন শিক্ষাবর্ষেও মূল ক্যাম্পাসে স্নাতকে (সম্মান) শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি এই কার্যক্রমও বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। ইউজিসি বলছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার আগ পর্যন্ত ভর্তিসহ এ সংক্রান্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে চিন্তা থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, নানা কারণে তা পূরণ হয়নি। এ অবস্থায় এক দশক আগে ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার আলোচনা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রথম দিকে এসব কলেজের পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছিল। এখনো সব সংকট না কাটলেও ধীরে ধীরে ক্লাস-পরীক্ষা পরিস্থিতির উন্নত হয়েছে।