চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি : সুখবর পাচ্ছেন চাকরি প্রত্যাশীরা

চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি:

নিজস্ব প্রতিবেদক,২৯ অক্টোবর ২০২২: বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই নিয়োগ প্রত্যাশীদের। বৈধভাবে সনদপ্রাপ্ত হওয়ার পরও নিয়োগ মিলেনি হাজার হাজার নিয়োগ প্রত্যাশীর। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে ১৬৬টি। হাজার হাজার টাকা অর্থ ব্যয় করেও সুফল পাননি চাকরি প্রত্যাশীরা।

১৪৫দিন (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) ধরে সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছেন প্যানেল প্রত্যাশীরা।

এনটিআরসিএ নিয়ে যেন সমস্যার অন্ত নেই। কোটি কোটি টাকা আয় করছে প্রতিষ্ঠানটি। নভেম্বরে আসছে ৭০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি। এবারের আবেদন ফি হবে এক হাজার টাকা।
নিয়োগ প্রত্যাশীদের দুর্ভোগ লাঘবে এনটিআরসিএ দু’টি অপশন চালু করতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপে ৪০টি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে পারবেন প্রত্যাশীরা।

একই সঙ্গে দ্বিতীয় অপশন নির্বাচনের সুযোগ দেয়া হবে তাদের। যারা দ্বিতীয় অপশন নির্বাচন করবেন তারা যদি প্রথম ধাপে ৪০ প্রতিষ্ঠানে সুযোগ না পান, তাহলে মেধা তালিকায় যে প্রতিষ্ঠান আসবে সেখানে যোগদান করতে বাধ্য থাকবেন। আর দ্বিতীয় অপশন নির্বাচন না করলে এই ৪০ প্রতিষ্ঠানে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকবেন তারা।

নিয়োগ প্রত্যাশী বিভিন্ন নিবন্ধনের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে দুর্ভোগের ভয়াবহ চিত্র মিলে। তারা বলেন, ২০০৫ সালে এনটিআরসিএন গঠন হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কমিটির আওতাধীন নিয়োগ হয়। এরপর থেকে নিয়োগের দায়িত্ব পায় এনটিআরসিএ। আগে পাস নম্বর হলেই নিয়োগ হতো। অভিযোগ আছে এ সময় প্রায় ৬০ হাজার জাল সনদ বিক্রি হয়েছে। এরপর ২০১৬ সালে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এ সময় ১৮০ টাকা করে যতো খুশি ততো আবেদন করতে পারতেন।

১০তম নিয়োগ পরীক্ষার একজন আবেদনকারী জাহিদ হোসেন বলেন, আমি প্রায় ২০ হাজার টাকার আবেদন করি। কিন্তু ফলাফলÑ নট সিলেক্টেড। বলা হলো জেলা, থানা কোটা নাই। তাহলে প্রশ্ন হলো- আবেদন করতে বললো কেন? এনটিআরসিএ তখনই আমাকে বাতিল হিসেবে গণ্য করতে পারতো।
২০১৭ সালে এই ফলাফলের প্রেক্ষিতে তারা মামলা করেন। সেসময় ১৬৬টি মামলা হয়। সেখানে রায়ে আদালত মেধা তালিকা করার নির্দেশনা দেন ৯০ দিনের মধ্যে। এরপর এনটিআরসিএ ৯০ দিনের শেষদিনে একটা মেধা তালিকা প্রকাশ করে।

আরেক চাকরিপ্রত্যাশী বলেন, এই ফলাফলে শুধুমাত্র তালিকা দেয়া হলো। যাতে নম্বর, সিরিয়াল কিছুই ছিল না। আলাদা করা হলো না আগেই চাকরিতে থাকাদের। এরপর বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ৪০ হাজার শিক্ষকের। ৩১ লাখ দরখাস্ত জমা পড়ে। আয় হয় প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। তারা বললেন, যারা ইনডেক্সধারী আছেন তারাও আবেদন করতে পারবেন। এর ফলাফলে অধিকাংশই আগের চাকরিজীবীরা চলে এলেন। আমরা বঞ্চিত হলাম কারণ ইনডেক্সধারীই মেধায় এলেন ২০/২২ হাজার। এখানে মেধার মূল্য থাকলো না। আমি টাকা থাকলে যতো খুশি ততো আবেদন করতে পারছি। ধরেন আমার সিরিয়াল পাঁচ হাজার। আমার পদ খালি আছে ছয় হাজার। আমাকে ছয় হাজার আবেদন করতে হয়। আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমি এতো পদে আবেদন করতে পারবো না। আমি সুযোগও পাবো না।

সায়মুন আরা বলেন, আবেদনের পর আরেকটি কৌশল নেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পাওয়া আরেকজন কত নম্বর পেয়েছেন তা আর দেখানো হয় না। এরপর ২০১৮ সালে আমরা আদালতে গেলাম। এখানে রায়ে আমাদের চাকরি দেয়ার কথা বলা হলো। আবার ২০২১ সালে তৃতীয় গণ-বিজ্ঞপ্তিতে আবার নিয়োগ দিলো। সেখানে ৫৪ হাজার পদের বিপরীতে প্রায় এক কোটি আবেদন হয়। একশ’ করে টাকা নিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা আয় করে এনটিআরসিএ।

তিনি আরও বলেন, এরপর আমরা দেখলাম একেকজন নিয়োগ প্রত্যাশী নম্বর পান ৯০ থেকে ৯৯ পর্যন্ত। আমাদের মাথায় আসে না এতো মার্ক কীভাবে পান। দ্বিতীয় গণ-বিজ্ঞপ্তির ২০ থেকে ২২ হাজার ইনডেক্সধারী তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি সুযোগ পান। অনেকেই চাকরি পরিবর্তন করে নিলেন। এনাদের কাছে আমরা আসলে ক্যাসিনো খেলার মতো। খেললেই টাকা। তারা পরীক্ষা নিয়ে একটা আয় করে আর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বড় একটা আয় করে।
১০তম নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরি না পাওয়া ইমরান হোসেন বলেন, সবশেষ ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের মধ্যে দুই হাজার ২০৭ জনকে সংরক্ষিত করা হলো। তাদের আর আবেদন করতে হলো না। আমাদের প্রশ্ন ১৩তম নিবন্ধনধারীরা যদি একই সনদপত্রে চাকরি পান তাহলে আমরা কেন পাবো না? তৃতীয় গণ-বিজ্ঞপ্তিতে যাদের বয়স ৩৫ তাদের আবেদন করতে দেয়া হয় নাই। এনটিআরসিএ’র অনিয়মের শেষ নেই। তাদের সৃষ্ট নিয়মই যেন একটা দুর্নীতির ফাঁদ। এনটিআরসিএ আমাকে সনদ দিয়েছে চাকরির জন্য। কিন্তু কেন আমি সনদ থাকার পরও চাকরি পাবো না?

আবার এদিকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৪৫ দিন ধরে সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছেন নিবন্ধনধারী প্যানেল প্রত্যাশীরা। এমনকি এই সময়ে সড়কেই ঈদ করেছেন তারা। তাদের দাবি- আবেদনের তথ্যানুযায়ী নিবন্ধিত শিক্ষকদের সম্ভাব্য সংখ্যা ২১ হাজার ৭৯৬ জন। আর স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক রয়েছেন ১৩ হাজার ৩১৮ এবং কলেজ পর্যায়ে আট হাজার ৪৭৮ জন। যেহেতু শূন্য পদ রয়েছে ৭০ হাজার সেহেতু তারা ব্যাচভিত্তিক নিয়োগের দাবি জানান। সেইসঙ্গে ১-১২তম নিবন্ধনধারী পর্যন্ত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন।

এনটিআরসিএ নিয়ে নানা অভিযোগের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এনটিআরসিএ’র একজন গাড়িচালকের দুর্নীতি ও অর্থের ফিরিস্তি উঠে আসে গণমাধ্যমে। যাতে দেখা যায় গাড়িচালক মো. জিয়াউর রহমান ১৭ বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর এই দুর্নীতি চক্রের হোতা সিস্টেম এনালিস্ট ওয়াসি উদ্দিন নাসির পরিবারসহ কানাডায় অবস্থান করছেন। তিনি মূলত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মচারীদের মাধ্যমে নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন এমন প্রার্থী জোগাড় করতেন। তার এই কাজে সহযোগিতা করতেন মাউশি’র সাবেক কর্মচারী নেতা বদিউজ্জামান, উচ্চমান সহকারী নজমুল হোসেন ও একটি প্রকল্পের গাড়িচালক মো. নজরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার এনটিআরসিএ’তে গিয়ে জানা যায়, এই গাড়িচালক জিয়াউর রহমান নিয়মিত অফিস করছেন। তবে তার কারণে বেশ চাপে রয়েছেন অন্যান্যরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকে শতর্ক অবস্থায় রয়েছে সবাই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও চাপ রয়েছে।

এনটিআরসিএ’র ওয়েটিং রুমে বসে থাকার সময় একজন কর্মচারীকে জিয়াউর রহমান নিয়ে প্রশ্ন করি। তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর বারবার অনুরোধ করেন যাতে তার নাম উল্লেখ না করতে। এরপর বের হবার পর তিনি আবারও অনুরোধ করেন। এনটিআরসিএ কর্মকর্তারা কতটা ভয়ে আছেন এ থেকে বোঝা যায়, শুধুমাত্র খোশ গল্প করাতেও ভয় পাচ্ছেন তারা।
এনটিআরসিএ সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, গাড়িচালক জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তের বিষয়ে আমরা এখনই কিছু বলতে পারছি না। তদন্তের পরই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা পিএসসি’র আদলে নন গভর্মেন্ট টিচার্স সার্ভিস কমিশন, এনটিএসসিএ করার জন্য একটা আইন খসড়া করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। যেটার উদ্দেশ্য একটাই হবে পরীক্ষা নেয়া ও সুপারিশ করা। পরীক্ষায় যারা পাস করে তাদের সনদ দেবো। তাদের মেধা তালিকা আমরা ওয়েবসাইটে দেয়ার পর ফিল্ড ইনফরমেশনের ভিত্তিতে চাহিদা পত্রের আলোকে সুপারিশ করবো।
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সচিব বলেন, শিগগিরই চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। আমরা তথ্যগুলো মাঠ থেকে পাওয়ার পর তিনটা অধিদপ্তরকে যাচাইয়ের জন্য দিয়েছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল অক্টোবরের মধ্যেই দেয়া। তবে আশা করছি নভেম্বরেই মধ্যেই হয়ে যাবে। আর আশা করা যাচ্ছে, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে শুরু থেকেই নিয়োগ দেয়া হবে। এরপর যোগদানের পর পুলিশ ভ্যারিফিকেশন চলবে। এরপর পূর্বের যারা নিয়োগ পেতেন তাদের একাধিক আবেদন করতে হতো। কিন্তু এখন আবেদন একটি করলেই চলবে। আবেদন ফি এক হাজার টাকা। এতে দু’টি অপশন থাকবে। প্রথমে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের পছন্দ দিতে হবে। দ্বিতীয় অপশন পছন্দ করলে ৪০টির মধ্যে না হলে যে প্রতিষ্ঠানে মেধা তালিকায় আসবে সেই প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য থাকবেন। এতে করে অনেক চাকরি প্রত্যাশীর অর্থ লাঘব হবে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।