স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ক্যামব্রিজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ চার শিক্ষক ও একজন এ্যাডমিনসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে র্যাব। গ্রেফতারকৃতরা এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা অবলীলায় স্বীকার করেছেন। এ নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে র্যাবের হাতেই গ্রেফতার হলেন ২৮ জন। সারাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
সোমবার র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অকাট্য প্রমাণাদি ও সাজ সরঞ্জাম। গ্রেফতারকৃতরা চার বছর ধরে একটানা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়, সবই হতো প্রযুক্তির মাধ্যমে। গ্রেফতারকৃতরা অনলাইনে নানা ছদ্মনামে গ্রুপ খুলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। এতে স্বাভাবিক কারণেই গ্রুপগুলো মানুষের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। গ্রেফতারের পর র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের নানা তথ্য।
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রয়োজনে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির পদ্ধতি পরিবর্তন করা হবে বলে সোমবার আনুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ওইদিন থেকে শুরু করে শনিবার ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট এগারোটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি বিষয়েরই বহুনির্বাচনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হোয়াটস এ্যাপ, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, ফাইবার, ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপের নামে ফাঁস হয়। এমন ঘটনায় সারাদেশের প্রতিটি জায়গায়ই একই আলোচনা হচ্ছে। তা হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। দেশে বিদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। প্রযুক্তির সুবিধা অসুবিধা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র ও এর ফাঁসের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের নীতি নৈতিক নিয়ে রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রকৃত রহস্য জানতে চায় হাইকোর্ট। তারই ধারাবাহিকতায় হাইকোর্ট গত ১৫ ফেব্রুয়ারি চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে তদন্ত করতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় ও একটি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আর বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের নেতৃত্বে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক সাত দিনের মধ্যে কমিটি কাজ শুরু করবে। আর ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবে। বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।
এর ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সারাদেশে রীতিমত অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার ভোর চারটার দিকে র্যাব-৩ এর একটি দল রাজধানী ঢাকার উত্তরখানের কাচকুড়া ও গাজীপুরের বোগড়া বাইপাস এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেফতার হয় চার শিক্ষকসহ একাধিক গ্রুপ তৈরি করে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের এক গডফাদার।
সোমবার বিকেলে কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন হাসানুর রহমান ওরফে রকি ভাই (২৯), সজীব মিয়া (২৬), মোঃ এনামুল হক (২৭), মোঃ ইব্রাহিম (২১) ও তানভীর হোসেন (২৯)। তানভীর হোসেন উত্তরখানের ক্যামব্রিজ হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দ্রুত সমাধান করে দিতেন। গ্রেফতারকৃত অপর চারজনের মধ্যে সজীব মিয়া ক্যামব্রিজ হাইস্কুলের এ্যাকাউন্টিং বিষয়ের শিক্ষক, মোঃ ইব্রাহিম ও মোঃ এনামুল হক সৃজনশীল কোচিং সেন্টারের শিক্ষক।
র্যাবে কর্মরত এই নৌবাহিনীর কর্মকর্তা জানান, হাসানুর রহমান ওরফে রকি ভাই একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার ফেসবুক আইডির নাম রকি ভাই। প্রশ্নপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। সে ফেসবুক গ্রুপের এ্যাডমিন। গত চার বছর ধরে রকি ভাই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল। রকি ভাই পরীক্ষার শুরুর ২ মাস আগে থেকেই ফেসবুক, হোয়াটস এ্যাপ, ইমোতে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার নম্বর আইডি দিয়ে প্রচারণা চালাতো। প্রচারণায় লেখা থাকতো, যারা প্রশ্ন পেতে চায় তাদের দুই হাজার টাকার বিনিময়ে তার গ্রুপের সদস্য হতে হবে। পরীক্ষার দিন ভোরে রকি ভাই প্রশ্ন ফাঁস করতো। এরপর তা গ্রেফতার হওয়া শিক্ষকদের দিয়ে সমাধান করাতো। সেই সমাধান পাঠানো হতো গ্রুপে যুক্ত থাকা পরীক্ষার্থীদের কাছে।
রকি ভাই ঘন ঘন গ্রুপের নাম পরিবর্তন করত। এমন সব নাম রাখত যা মানুষের মধ্যে কোন সন্দেহের সৃষ্টি করতে না পারে। এজন্য সে ব্লাড ডোনেশন-১, ২ ও ৩ নামে তিনটি গ্রুপ খুলেছিল। এতে করে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছিল। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ট্যাবের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ভেতরে এসএসসি পরীক্ষার বিভিন্ন প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে।
চলমান এসএসসি পরীক্ষার সকল বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেছে গ্রেফতারকৃতরা।
প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পৃথক পৃথক গ্রুপ খুলত। এবারের এসএসসি পরীক্ষার মজা নামে গণিতের প্রশ্নপত্র, আড্ডা নামে ইংরেজী দ্বিতীয়পত্র এবং পরবর্তী পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ব্লাড ডোনেশন-১, ২ ও ৩ নামে গ্রুপ খুলে ফাঁস করেছিল। প্রতিদিন পরীক্ষা শেষে গ্রুপের নাম পরিবর্তন করে দিত। গ্রুপ থেকে মেম্বারদের পরিবর্তন করে ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা প্রাপ্তিসাপেক্ষে নতুন গ্রুপে মেম্বার করত। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র গ্রেফতারকৃতরা দুই ঘণ্টা আগেই ছাত্রদের হাতে প্রশ্নের সমাধান করে দিয়ে দিয়েছে। সে হিসেব মনে অন্তত আড়াই ঘণ্টা আগে এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে সক্ষম হয়েছিল গ্রেফতারকৃতরা। এর নেপথ্যে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক এমরানুল হাসানসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, এবার এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক, ছাত্রসহ নানা শ্রেণী পেশার অন্তত ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে খুুলনা মহানগর থেকে ৯ জন, নাটোর থেকে ১০ জন, চট্টগ্রাম থেকে ৩ জন, কুষ্টিয়া থেকে ১ জন ও বগুড়া থেকে একজনসহ মোট ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। সারাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোন ছাড় দেয়া হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতারে র্যাব প্রয়োজনে আরও কঠোর অবস্থানে যাবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন নির্দেশনাই এসেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে শিক্ষাসচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি চলমান থাকলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো সম্ভব নয়। পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন নিয়ে সরকার ভাবছে। আগামী বছর থেকে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির পদ্ধতি পরিবর্তন করা হবে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানান। তিনি এমসিকিউ পদ্ধতির কথা বলেন। প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির পদ্ধতি পরিবর্তনের কথাও বলেন তিনি।
আক্কেলপুরে গ্রেফতার ১ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্র বিক্রির সময় বিপুল হোসেন নামে এক ছাত্রকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনাটি জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঘটে। সোমবার এসএসসির জীববিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিক্রির সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। সে জামালগঞ্জ কলেজের একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা পূর্বে ওই কেন্দ্রের সামনে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নপত্র বিক্রি করার সময় তাকে আটক করা হয়। সে উপজেলার পূর্ব মাতাপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে। তার আটক করা মোবাইলের ম্যাসেঞ্জার থেকে সরবরাহ প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জীববিজ্ঞান পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
কেন্দ্র সচিব বহিষ্কার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নাজিরপুরে এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের সেট পরিবর্তনের অভিযোগে কেন্দ্র সচিবকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উপজেলার সিরাজুল হক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সোমবার এ ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ মাহিদুল ইসলাম জানান, ওই দিন ওই কেন্দ্রে জীববিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ের ২৬৮ পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। ওই কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিবের কারণে ওই দিনের জন্য বোর্ড নির্ধারিত ‘ক’ সেটের পরিবর্তে ‘খ’ সেটের প্রশ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিষয়টি পরীক্ষা শুরুর ২১ মিনিট পর কর্তৃপক্ষের চোখে ধরা পড়ে এবং ওই সেট দিয়েই পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে পরীক্ষা শেষে ওই কেন্দ্রে গেলে কেন্দ্র সচিব উপজেলার সিরাজুল হক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র দাস ও সহকারী কেন্দ্র সচিব উপজেলার শ্রীরামকাঠী ইউজেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ ম-লকে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঝুমুর বালা জানান, এ অভিযোগে ওই কেন্দ্রের সচীব মাধব চন্দ্র দাসকে বহিষ্কার করা হয়েছে।