কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের মাসিক ভাতা দিয়ে সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার দাবী

Image

কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রেশন করেনি। তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনা। তাই বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন খোলার ব্যাপারে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে। এটি মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।’ গত ২৬ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন তার মন্ত্রণালয়ে কিন্ডারগার্টেন খোলার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ মন্তব্য করেন। যা দৈনিক শিক্ষাডটকমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। মন্ত্রী মহোদয়ের শিশু শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ অনেকটা অভিভাবক নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন। শিশু শিক্ষার বৈষম্যকে আরও ঘনীভূত করেছে।

সারাদেশে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের অধ্যাদেশ মোতাবেক কিন্ডারগার্টেন রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এসেছে। আমার মতে, এক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রী যদি সারাদেশের সব কিন্ডারগার্টেন এখনো রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আসেনি বলে মন্তব্য করতেন তাহলেও সঠিক হতো। সারাদেশে আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা সব বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব কিন্ডারগার্টেন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা ও বিনামূল্যে বই গ্রহণের সুযোগ পেয়েছে। করোনার সময়ে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক নেতারা প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে তাদের দুঃখ কষ্টের কথা জানিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে প্রতিমন্ত্রী এক টকশোতে বলেছেন, ‘কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকেরা অনেক কষ্টে আছেন।’

কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক নেতারা প্রাথমিকের সচিব, ডিজির সাথে শিশু শিক্ষার মানোন্নয়নে তাদের ভূমিকা রাখার জন্য একাধিকবার দেখা করেছেন। কিন্ডারগার্টেন সরকারের সান্নিধ্যে পেয়ে শিশু শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। ‘সেখানে তারা যোগাযোগ করেনা’ প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যে আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেকটা হতাশায় নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। করোনার সময়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্টভাবে প্রাথমিকের সাথে কিন্ডারগার্টেনকেও বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সারাদেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন মোতাবেক বন্ধ আছে। অথচ প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বক্তব্যে বলেছেন, ‘কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় খোলা তাদের ব্যাপার। মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।’

কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী, শিক্ষকেরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কিন্ডারগার্টেনের জন্য অন্য কোন মন্ত্রণালয় নেই। তারা বিগত সময়ে কিন্ডারগার্টেনগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে আসছে। সেহেতু কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। হঠাৎ করে কিন্ডারগার্টেন সম্পর্কে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য কতটুকু যুক্তিসংগত তা ভাবনার বিষয়। আশা করি কিন্ডারগার্টেন নিয়ে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য সংশোধন করবেন। কিন্ডারগার্টেন সরকারি বেতন ভাতা বা অনুদান ছাড়া শিশু শিক্ষার বিশাল অবদান রাখার কাজটি করে যাচ্ছেন। আশা করি অভিভাবক হিসেবে তিনি কিন্ডারগার্টেনের গুরুত্ব ও ভূমিকা উপলদ্ধি করে শিশুর শিক্ষার মান উন্নয়নে সহযোগীতা করে যাবেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক সমিতির মহাসচিব শেখ মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র সব শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করবেন। এ প্রেক্ষিতে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলো সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। শিশু শিক্ষায় কিন্ডারগার্টেনের বিশাল অবদান স্বীকৃতি দিয়ে মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য সংশোধন করার আশা পোষণ করেছেন এ শিক্ষক নেতা।

যেহেতু শিশু শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠান। শিশু শিক্ষার স্বার্থে প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও শিশুদের মনিকোঠায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্বের মতো এখন খোলা মাঠে পাঠদান, আসবাবপত্রের সংকট, ভৌতঅবকাঠামো সংকট এখন আর খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়না। আজকাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মনোরম সুসজ্জিত বহুতল ভবন। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, ছোট শিশুর প্রাক প্রাথমিকের ক্লাস রুম অত্যাধুনিক সজ্জিত। যা শিশু মনকে বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক খেলাধুলা গান, ছড়া ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে পড়াশোনার শিশুর শৈশব সূচনা করে থাকেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেশিরভাগ অনার্স মাস্টার্স পাস। অপরদিকে সিইনএড, ডিপিএড, বিএড ও এমএড প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। এছাড়া সারা বছর বিষয়ভিত্তিকসহ নানা ধরনের ট্রেনিং ইউআরসি থেকে পেয়ে থাকেন। এক কথায় বর্তমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশু শিক্ষায় অনেকটা আশার আলো জ্বালাতে সক্ষম হচ্ছে। অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকেরা বেশিরভাগ কমযোগ্যতা সম্পন্ন। মেধাবী উচ্চ শিক্ষিতরা ভাল পেশায় চাকরি না হওয়া পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এ অবস্থা অনেকটা প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও। পদোন্নতির সুযোগ রুদ্ধ থাকায় ও বেশি বেতন সুযোগ পেলে অনেক প্রাথমিকের শিক্ষকও এ পেশা ছেড়ে চলে যায়। মেধাবী উচ্চশিক্ষিতদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে থার্ড ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস পদমর্যাদা দূর করে ১ম শ্রেণির মর্যাদা ও বেতন স্কেল দেয়ার বিকল্প নেই। এতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে প্রাথমিক শিক্ষকেরা বেশি উৎসাহিত হবে। বিশেষ করে শিশুশিক্ষায় কিন্ডারগার্টেনে ট্রেনিংবিহীন শিক্ষক বিধায় আগামী প্রজন্মের এক অংশের পাঠদান যথাযথভাবে আনন্দ মুখর পরিবেশে হয়ে উঠেনা। তাতে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়। দেশের একাংশের শিক্ষার্থীদের শিশু মনোবিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা বাইরে রেখে ট্রেনিংবিহীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান কোন অবস্থায় কাম্য নয়।

প্রবাদ আছে ‘শিশু মনোবিজ্ঞান ছাড়া শিক্ষা, ছিদ্র থলির ভিক্ষা’। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এ পেশার মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম যথাযথ জ্ঞানের প্রসার ঘটাবে এটাই সকলের বাসনা। এ প্রেক্ষপটে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে শিশুর মেধা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি :

* ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের কিন্ডারগার্টেন অধ্যাদেশ সংশোধন করে সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা।

* কোনো অবস্থায় শিক্ষার পরিবেশবিহীন বিদ্যালয়কে রেজিস্ট্রেশন না দেয়া। শিশুর খেলার মাঠ, জাতীয় ও বিশেষ দিবস জাঁকজমকভাবে পালন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যা প্রত্যেক শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

* স্বল্প সময়ের জন্য ইউআরসিতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ উপজেলা বা থানা পর্যায়ে বছরে কমপক্ষে ১ সপ্তাহ সকল শিক্ষকের শিশুমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। যাতে শিশুর পাঠদান বয়স, রুচি ও সামর্থের বাইরে না যায়।

* জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে সকল বই পড়ানো নিষিদ্ধ করা।

* কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় তদারকি করার জন্য ১ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদেরকে দায়িত্ব দেয়া।

* কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের মাসিক ভাতা দিয়ে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হলে, তারা সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী শিশু শিক্ষার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে।

দেশের এক অংশের শিশুদের ট্রেনিংবিহীন শিক্ষকের বাহিরে রেখে মানসম্মত শিশুশিক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা তথা আগামীর সুনাগরিক তৈরি হতে পারে না। শিক্ষা নিয়ে যারা ভাবেন তাদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এদেশের সকল শিশুকে নিয়ে ভাবুন। কারণ আপনি শিশুদের রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক। কোনো অবস্থায়ই আপনি শিশু শিক্ষার দায় এড়াতে পারেন না।

দেশের সকল শিশুর শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার দৃষ্টিভঙ্গি সকলের মাঝে আসুক। এ আশা নিয়ে জাতি আর কতদিন সময়ক্ষেপণ করবে ? সুশিক্ষায় বিকশিত হোক আগামী প্রজন্মর ভবিষ্যৎ। সকলের মানসিকতা থেকে শিশুদের মাঝে বৈষম্যের দেয়াল তৈরি করা থেকে দূর হোক। এ প্রত্যাশায়।

লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।