একটি সিনেট অভিভাষণ ও কলেজশিক্ষার মানোন্নয়ন

ড. ফজলুল হক সৈকত ঃপ্রশাসনিক বিকেন্দ্রিীকরণ, মোটিভেশন ও প্রণোদনা প্রদান, সাফল্যের স্বীকৃতি ও সম্মাননা, ই-ম্যানেজমেন্ট এবং শিক্ষার বাস্তবভিত্তিক প্রসার ও মান-উন্নয়ন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব-পরিপ্রেক্ষিতে যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ভাবনাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রশাসনকে গতিশীল করে সামনে এগোনোর সময় এখন। বাংলাদেশও উন্নয়নের নানান ক্ষেত্রে এসব ইতিবাচক ধারণার প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপ ও যোগ্য নেতৃত্বে উন্নয়নের জন্য পরিবের্তনের যে ধারা প্রবাহিত হয়েছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় এসেছে বিচিত্রমুখি পরিবর্তন। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় আসন-সংকট ও সেশনজট যখন একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে রয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইতিবাচক পরিবর্তন, মানোন্নয়ন ও কাজে গতিশীলতা প্রতিষ্ঠার নজির সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি. বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রদত্ত একটি অভিভাষণকে সামনে রেখে আমরা কিছু বিশেষ বিষয়ে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবো।

২৯ ডিসেম্বর ২০১৫। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ সিনেট অধিবেশন। ভাইস-চ্যান্সেলর ও সিনেট চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ-এর অভিভাষণ। কলেবরের বিবেচনায় খুবই ছোটÑ মাত্র ৮ পৃষ্ঠা। সম্পূর্ণ বা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে, প্রারম্ভিক কাজ শুরু হয়েছে এবং অল্প সময়ের ভেতরেই শুরু হবে এমন ১৬টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে ভিসি ২০১৬ সালে তার কর্ম-পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। ১৬টি পদক্ষেপের শিরোনামগুলো তুলে ধরছি পাঠকের জন্য : সংশোধিত ডিপিপি, কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সাথে যৌথ কর্মশালা, কল সেন্টার স্থাপন, ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারের কার্যক্রম শুরু, মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ, কলেজ র‌্যাঙ্কিং, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ বিষয়ে কলেজ শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ, আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রাতিযোগিতা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ, ই-ফাইলিং, শিক্ষাকার্যক্রমে নতুন বিষয়, অনার্স প্রথম বর্ষে জিপিএ-র ভিত্তিতে ভর্তি এবং ভর্তি ও ক্লাস শুরুর সময় এগিয়ে আনা, ক্রাশ প্রোগ্রাম ও একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ, আঞ্চলিক কেন্দ্রে স্ট্রংরুম স্থাপন, মাহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাফল্য। এবং অভিভাষণটির প্রায় শেষে সিনেট সভাপতি বলেছেন : ‘আমাদের জন্য ২০১৬ সাল হবে খুবই কর্মবহুল’।

প্রসঙ্গত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা ছাড়াও রাষ্ট্রপতি মনোনীত ৫জন শিক্ষাবিদ, স্পীকার কর্তৃক মনোনীত প্রত্যেক প্রশাসনিক বিভাগ থেকে একজন করে সংসদ সদস্য, সরকারকর্তৃক মনোনীত ৩জন অন্যূন যুগ্মসচিব, দেশের সকল প্রশাসনিক বিভাগের কমিশনার, শিক্ষাবোর্ডসমূহের চেয়ারম্যান, দেশের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা-প্রশাসক, পেশাজীবী, একাডেমিশিয়ন, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনীত অধ্যাপক, দেশবরেণ্য গবেষক, মনোনীত কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমন ব্যাপক ও বৈশিষ্ট্যম-িত সিনেট দেশে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ সিনেট। গত প্রায় ৩ বছরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টিম সেশনজটমুক্ত অনলাইন বেইজড বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এবং শিক্ষার মনোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ২ জন প্রোভিসিÑ সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আসলাম ভূইয়া, প্রযুক্তিবিদ প্রফেসর ড. মুনাজ আহমেদ নূর, কোষাধ্যক্ষ মাউশি’র সাবেক ডিজি অধ্যাপক নোমান উর রশীদ এবং ৩ জন ডীন, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কলেজ পরিদর্শকসহ দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই উন্নয়নের ধারায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।

বিশেষ সিনেট আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাসঙ্গিকতা বর্ণনা করতে গিয়ে উপস্থিত সদস্যের প্রতি ড. হারুনের আহ্বানটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বক্তব্যের চুম্বক-অংশ তুলে ধরছে : “কীভাবে আমরা কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে পারিÑ সে বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ ও সুপারিশ পেতে এই বিশেষ সিনেট অধিবেশনের আয়োজন। এ বিষয়ে আপনাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্যকে আমরা স্বাগতম জানাব। জরুরি বিবেচনায় আমরা ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’র বাইরে এ সিনেট অধিবেশনে কতিপয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তা এজেন্ডা আকারে নিয়ে এসেছি। তবে, কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার হবে আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়।”

শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রণোদনা ও পুরস্কার প্রদান বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও গত ২৩ বছরে তা করা হয়নি। এই সিনেট অভিভাষণে মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন। সেরা কলেজ, সেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নির্বাচন করে তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করলে প্রতিযোগিতা মনোভাব যেমন বাড়বে, তেমনই বৃদ্ধি পাবে লেখাপড়া ও গবেষণার মান। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে কলেজশিক্ষার মানোন্নয়নে নিয়মিত একাডেমিক মনিটরিয়ং-এর কথা থাকলেও, তার কোনো বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এই বিশেষ সিনেট অধিবেশন নিশ্চয়ই দীর্ঘদিনের ওই বন্ধ্যাত্ব ও জটিলতা দূর করতে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি যদি আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা সম্পন্ন ভাষা ইনস্টিটিউট বা ভাষা-গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা বাস্তবায়নের অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হবে।

সিনেট অভিভাষণটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রসঙ্গ। প্রথমবারের মতো সমাবর্তন আয়োজন করতে যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ যুগ পূর্তির বছরে ২০১৬ সালের শেষপ্রান্তে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বৃহৎ ও ব্যতিক্রমি অনুষ্ঠান। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধান ভেন্যু এবং দেশের সব বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবস্থায় সাব-ভেন্যুতে এই অনুষ্ঠান পরিচালিত হবে। এ বিষয়ে সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর (একাডেমিক) তরুণ প্রযুক্তিবিদ প্রফেসর ড, মুনাজ আহমেদ নূর-এর নেতৃত্বে গঠিত একটি টেকনিক্যাল কমিটি প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে। ৪০ লক্ষাধিক গ্র্যাজুয়েটের জন্য এই অভিনব আয়োজনটি হবে ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি নজির সৃষ্টিকারী ঘটনা’। অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থেকে গ্র্যাজুয়েটদের আশীর্বাদ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

বিশেষ সিনেট অধিবেশনের এই অভিভাষণের আহ্বান বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত সকলে যদি অন্তরিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করেন, তাহলে কলেজশিক্ষার মানোন্নয়নে সাধিত হবে বিপ্লবী ঘটনা। কেবল ঘোষণা কিংবা আহ্বানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যদি সত্যি সত্যি সকল আইডিয়া ও পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ২০১৬ সাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মডেলও হয়ে উঠতে পারে।

লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।