বিশেষ প্রতিবেদক:রমজানের শুরুতেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ছিল ঈদের ছুটি। কথা ছিল ঈদের পর জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শেষ নাগাদ একে একে খুলবে রাজধানীর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো। এর মধ্যেই গুলশানে ঘটে যায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ভয় আর আতঙ্ক ঘিরে ধরে নামিদামি স্কুলগুলোকে। এর জের ধরে এখনো বন্ধ রয়েছে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বন্ধ থাকা স্কুলগুলো মাঝে কয়েক দফায় খোলার তারিখ ঘোষণা করেছিল। সর্বশেষ বলা হয়েছিল ২৮ ও ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে। সেই ঘোষণাও কার্যকর হয়নি। এখন কর্তৃপক্ষ খোলার নতুন কোনো তারিখও দিচ্ছে না, স্পষ্ট করে কিছু বলছেও না। না খোলার তালিকায় আছে স্কলাসটিকা, মাস্টারমাইন্ড, সানবিম, আগা খান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা, লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও সানিডেলের মতো নামিদামি স্কুলগুলো।
অভিভাবকরা বলছেন, স্কুল কবে খুলবে তা জানানো হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা দেড়-দুই মাস ধরে বাসায় বন্দি থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা। এমনকি কেউ কেউ স্কুল পাল্টানোর কথাও ভাবছেন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বলে এর কোনো দায়দায়িত্বই নিচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এম নিজাম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ জন্য অনেক স্কুলই একটু দেরি করে খুলছে। অনেকেই দেশের পরিস্থিতি অবজার্ভ করছে। তাই তারা সুনির্দিষ্ট তারিখও দিতে পারছে না। আসলে কী হয় না হয় তা আরেকটু দেখেই কিছু স্কুল তাদের খোলার তারিখ ঘোষণা করবে।
জানা যায়, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বাংলাদেশের হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি অধিদপ্তর তাদের ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চায় না। এমনকি এ স্কুলগুলোর ব্যাপারে তাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই, এমনকি যোগাযোগও নেই সেভাবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর ব্যাপারে আমাদের কাছে ডে টু ডে সুপারভিশনের রিপোর্ট নেই। অনেক স্কুলই যে বন্ধ সে ব্যাপারে ফরমালি রিপোর্টও আমাদের কাছে নেই। তবে আমরা তাদের একটা নীতিমালার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। অধিদপ্তরের সঙ্গে লিংকেজটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত জুনের শুরুতেই গ্রীষ্মকালীন ও ঈদের ছুটির জন্য বন্ধ হয়ে যায় স্কলাসটিকা স্কুলের পাঁচটি শাখা। গত ২৪ জুলাই তাদের স্কুল খোলার কথা ছিল; কিন্তু অভিভাবকদের জানিয়ে দেওয়া হয় অনিবার্য কারণে স্কুল বন্ধ থাকবে। কবে খুলবে এখন তা-ও জানানো হচ্ছে না। মাস্টারমাইন্ড স্কুলও গত ২৪ জুলাই খোলার কথা ছিল; কিন্তু তা পিছিয়ে ৩১ জুলাই করা হয়। তবে সেদিনও স্কুল খোলেনি। এখন কবে খুলবে সে ব্যাপারে অভিভাবকদের কিছু জানানো হচ্ছে না। সানিডেল স্কুল খোলার কথা ছিল গত ৩১ জুলাই। কিন্তু ওরিয়েন্টেশন শেষে জানিয়ে দেওয়া হয় অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণে আপাতত স্কুল বন্ধ থাকবে। পরবর্তী সময়ে খোলার তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। সানবিম স্কুল ও লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও গত সপ্তাহে খোলার কথা ছিল। কিন্তু উভয় প্রতিষ্ঠান গতকাল সোমবার পর্যন্ত বন্ধ ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীই বিদেশি নাগরিক। আবার গুলশানে জঙ্গি হামলায় জড়িত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই ছিল নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী। রোহান ইমতিয়াজ ও মীর সামিহ মোবাশ্বের পড়ত স্কলাসটিকা স্কুলে। নিরবাস ইসলাম পড়েছে ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। গুলশান হামলায় নির্বিচারে বিদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনায় এখন বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আতঙ্কে রয়েছেন।
গতকাল দুপুরে স্কলাসটিকা স্কুলের গুলশান শাখায় গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। দুই গেটে দুজন গার্ড ছাড়া আর কারো দেখা মেলেনি। তবে জানা যায়, সকালের দিকে কিছু শিক্ষক এসেছিলেন, তাঁরা চলে গেছেন। একটি গেটে দায়িত্ব পালন করছিলেন অরনেট সিকিউরিটিজ কম্পানির নিরাপত্তা প্রহরী সিদ্দিক মিয়া। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই স্কুল বন্ধ। দু-একজন অভিভাবক মাঝেমধ্যে আসেন, আমাদের কাছে জানতে চান। কিন্তু কবে স্কুল খুলবে তা তো আমরা জানি না। আমাদের সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুজন পুলিশ সদস্যও দায়িত্ব পালন করেন।’
স্কলাসটিকা স্কুলের যোগাযোগ সমন্বয়কারী জিয়া হাশান বলেন, ‘স্কুল খোলার এখনো কোনো তারিখ ঠিক হয়নি। তবে আশা করছি, এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যে খোলা সম্ভব হবে। আমাদের কিছু নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার ছিল। কিছু নতুন ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়েছে। এগুলোর কাজ সম্পন্ন হলেই স্কুল খোলা হবে। এ ছাড়া আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও সহায়তা চেয়েছি। তারা এখনো নিরাপত্তা দিচ্ছে। আর অভিভাবকদের আমরা মেসেজ করেছি। তবে স্কুল খোলার দিনক্ষণ নির্ধারণ না হওয়ায় তাঁদের ডেট দিতে পারছি না।’
গতকাল ধানমণ্ডিতে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল খুললেও উপস্থিতি খুবই কম। আগের মতো শিক্ষার্থীর আনাগোনা নেই। ক্যাম্পাসও অনেকটা নীরব। নাম প্রকাশ না করে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত সপ্তাহেই স্কুল খোলা হয়েছে। বাচ্চারা বাসায় থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাচ্ছিল। অভিভাবকরাও উৎকণ্ঠায় ছিলেন কবে স্কুল খুলবে। তাই স্কুল খোলা হয়েছে। তবে বাচ্চাদের ব্যাগও চেক করে ঢোকানা হচ্ছে।’
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ধানমণ্ডি শাখার দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক চায়না খান বলেন, ‘রোজার শুরুতেই স্কুল বন্ধ হয়েছে। দুই মাস হয়ে গেল। একবার বলল ২৪ জুলাই খুলবে, এরপর ৩১ জুলাই। এখন কবে খুলবে তাও বলছে না। স্কুল না খুললে বাসায় তেমন পড়ালেখা হয় না। খুবই চিন্তায় আছি। আমরা অভিভাবক, তার পরও স্কুলে গেলেও আমাদের কোনো দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে না।’
স্কলাসটিকা স্কুলের গুলশান শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এই স্কুলের শিক্ষার্থী ঐশীকে নিয়ে একবার কত কিছু হলো। এখন আবার জঙ্গি তালিকায়ও নাম উঠেছে। দুইবার ডেট দিয়েও স্কুল খুলল না। একবার শুধু এসএমএস পাঠিয়েছে। স্কুলে গেলেও কেউ ভালো করে কথা বলে না। আমার বাচ্চা যে এই স্কুলে পড়ে এখন সেটাই আর মনে হয় না। তাই চিন্তা করছি বাচ্চাকে অন্য স্কুলে দেওয়ার।’
জানা যায়, সারা দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৩৫০। এসব স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা ১৫৯, শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬৪ হাজার ৫০৭ জন। তবে এর মধ্যে নামিদামি স্কুলের সংখ্যা ১০ থেকে ১২টি। এর মধ্যে রয়েছে স্কলাসটিকা, মাস্টারমাইন্ড, সানবিম, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা, লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, আগা খান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও সানিডেল স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সংখ্যাই প্রায় ৩০ হাজারের কাছাকাছি। এই স্কুলগুলোই বন্ধ রয়েছে।
সূত্র জানায়, বন্ধ থাকা স্কুলগুলোতেই রয়েছে বেশির ভাগ বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এ কারণে তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় কাজ করছে। তাই স্কুল কর্তৃপক্ষ আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই স্কুল খুলতে চাচ্ছে।
বারিধারায় সিডনি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল কাজী নাসরিন সিদ্দিকা বলেন, ‘আমাদের স্কুল কিছুদিন আগেই খুলেছে। প্রথম দিকে উপস্থিতি ছিল ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এখন সেটা বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আমরা প্যারেন্টস মিটিং করলাম। তাঁরা আরো নিরাপত্তার কথা বলেছেন। স্কুলের মেসেজ সিস্টেমটা আরো জোরদার করার কথা বলেছেন। আসলে কয়েকটি ঘটনার পর মানুষের মধ্যে একটা ট্রমা কাজ করছে, যা থেকে অনেকেই বের হতে পারছেন না। আর যেসব স্কুলে বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের চিন্তাটা আরো বেশি।’
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান (মিডিয়া) বলেন, ‘আমার জানামতে স্কুল বন্ধ রাখার ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা নেই। যারা আমাদের কাছে নিরাপত্তা চাচ্ছে তাদেরই নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতির ওপরই আমরা বিশেষ নজরদারি রাখছি।’
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আমিনা রত্না বলেন, ‘আমার বাচ্চা ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে পড়ে। ওদের স্কুল এক দফা পিছিয়ে গত সপ্তাহে খুলেছে। ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও খুলেছে। কিন্তু অনেক অভিভাবকই জানাচ্ছেন তাঁদের বাচ্চাদের স্কুল খোলেনি। আমাদের নিরাপত্তাও দরকার, আবার পড়ালেখাও দরকার। গ্রীষ্মকালীন ও ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর স্কুল না খুললে বাচ্চারা পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এখন ধানমণ্ডি এলাকায় নামিদামি বাংলা মাধ্যমের স্কুল খুলেছে। কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও খুলেছে। তাহলে বাকিদের খুলতে সমস্যা কোথায়, তা তো বুঝতে পারছি না। আর না খোলা গেলেও অভিভাবকদের নিয়ে মিটিং করে তাঁদের বিষয়টা বোঝানো উচিত।’
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘ওদের (ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল) আমরা তদারকি করি না। ওরা আমাদের কথা শোনেও না। তার পরও আমাদের শিক্ষার্থীরাই তো পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। যদি এখনো বন্ধ থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই খোঁজ নেব। কেন বন্ধ আছে তা জানতে চেয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’