নিজস্ব প্রতিবেদক | ১৮ আগস্ট , ২০১৯:
স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার।
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে স্ত্রীকে নিয়ে কুমেক হাসপাতালে যান ইমদাদুল হক।
হাসপাতালের কর্তব্যরত কর্মী ও চিকিৎসকদের কাছে নিজের পরিচয় সে সময় প্রকাশ করেননি তিনি।
এ নিয়ে ভুক্তভোগী ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শুক্রবার সকালে ও বিকালে তার ফেসবুক আইডিতে দুটি স্ট্যাটাস দেন, যেখানে কুমেক হাসপাতালে তার বিড়ম্বনার নানা তথ্য তুলে ধরেন।
তার সেই স্ট্যাটাস নেট দুনিয়ায় গতকাল থেকে ভাইরাল।
ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদারের সেই স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হল,
‘রাত ৩:৩০। আমার স্ত্রীর হঠাৎ তীব্র পেট ব্যথা। ও চিৎকার করছিল। খুব ঘাবড়ে গেলাম। ইমার্জেন্সি অ্যাম্বুলেন্সের অনেকগুলো নম্বর নিয়ে কল করতে থাকলাম। কেউ কল ধরল না।
বড় বড় হাসপাতালের নম্বরে কল দিলাম। কেউ ধরল না। একজন দয়া করে অ্যাম্বুলেন্সের কল ধরে জানালেন তার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায়। পাওয়া গেল না।
আমার মোটামুটি সব ড্রাইভারকে কল দিলাম। ধরল না। অসহায় অবস্থায় বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটা দিলাম ফাঁকা রাস্তায়। কিছুদূর গিয়ে একটা সিএনজি পেলাম। উনি যেতে রাজি হলেন। গেলাম কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি তখন ঘুমাচ্ছে।
অনেক কষ্ট করে ডিউটি ডাক্তার সাহেবের ঘুম ভাঙানো হল। উনি কাগজে লিখে দিয়ে ৪তলায় ৪১৭ নম্বর ওয়ার্ডে যেতে বললেন। গেলাম।
ওখানে ১৫ মিনিট কাউকে পেলাম না। অবশেষে এক সিস্টার বা আয়া এমন কেউ এলেন। জানলাম ডাক্তার সাহেব ঘুমাচ্ছেন।
পাক্কা আধা ঘণ্টা ধরে দরজা নক করার পর উনি এলেন। দেখলেন। তার পর ব্যবস্থাপত্র লিখতে গিয়ে দুটো কলমই কালিশূন্য পেলেন।
আবার গেলেন তার কক্ষে। গিয়ে ফিরলেন আরও ১০-১২ মিনিট পর।
এ দিকে বেশ কয়েকজন রোগী জমে গেছে।
অবশেষে আমার স্ত্রীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ লিখলেন- এলজিন ইঞ্জেকশন, নরমাল স্যালাইন আর খাবার স্যালাইন।
মজার বিষয় হল ডাক্তার সাহেব সঙ্গে অতিরিক্ত দুটো স্লিপ ধরিয়ে দিলেন।
স্লিপ-১ : ৭টি টেস্টের নাম স্লিপ-২ : বাদুরতলার শেফা ও আজাদ ক্লিনিকের নাম।
মুখে বলে দিলেন এই টেস্টগুলো যেন ওখান থেকেই করাই। অনেকটা আদেশের মতো।
আমি ভেজা বিড়ালের মতো বললাম, জি আচ্ছা। এর মাঝে কথা হল দেবিদ্বার থেকে আসা এক ডেঙ্গু রোগীর স্বজনের সঙ্গে। তার মহিলা রোগীর প্লাটিলেট কমেই চলেছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
কিন্তু মজার বিষয় হল রোগীর ওয়ার্ডে কোনো ডাক্তার নেই। ডাক্তার আসবেন সকালে অথবা আরও পরে। পরে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে এলাম।
ইঞ্জেকশনটা একটা বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে পুশ করালাম।
উপলব্ধি-০১ : গরিবের জন্য কোনো চিকিৎসা নেই
উপলব্ধি-০২ : ডেঙ্গু নিয়ে প্রান্তিক লেভেলে সরকারের নির্দেশনা কতটা ফলো করা হচ্ছে তা ভেবে দেখার আছে।
উপলব্ধি-০৩ : আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ২৪ ঘণ্টার নয় বরং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (সরকারি/ বেসরকারি) দায়িত্বশীলদের মর্জি মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে।
উপলব্ধি-০৪ : অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিক কেবল সকাল-সন্ধ্যা দোকান খোলে। ব্যবসা শেষে দোকান বন্ধ। রোগী জাহান্নামে যাক।
যা আইনত দণ্ডনীয়। ক্লিনিকে অবশ্যই ইমার্জেন্সি ডাক্তার থাকা বাধ্যতামূলক।
উপলব্ধি-০৫ : যত দায় আমাদের।
# রমজানে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধ করো সকাল-সন্ধ্যা
# রাত জেগে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা করো
# ঘুম হারাম করে দুর্যোগ মোকাবিলা করো
# ইলেকশনে টানা রাত জেগে কাজ করো
# ঈদে নির্বিঘ্নে জনসাধারণের বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত করো
# জাতীয় দিবসের প্রস্তুতিতে অঘুম রাত কাটাও
# বিশেষ সংকটে জেগে থাকো রাতের পর রাত আর খেটে যাও সংকট মোকাবিলায়।
মেডিকেল সেক্টরের জন্য করুণা। স্রোষ্টা হেদায়েত দান করুণ। আমিন।’
শুক্রবার দিনব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলে নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের সেই স্ট্যাটাসটি।
দেশের চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে চিকিৎসকদের কটাক্ষ করা শুরু হয় মন্তব্যের ঘরে।
এ সব মন্তব্যের মধ্যেই শুক্রবার রাতে স্ট্যাটাস দুটি ফেসবুক থেকে মুছে দেন ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
তবে ইতিমধ্যে তার সেই স্ট্যাটাসটি স্ক্রিনশট আকারে নানাজনের টাইমলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক তালুকদার জানান, ‘কোনো হাসপাতাল বা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করিনি আমি। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে কুমেকে গিয়ে যে ভোগান্তির শিকার হয়েছি তা প্রকাশ করেছিলাম মাত্র।’
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে কুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. স্বপন কুমার অধিকারী বলেন, হ্যাঁ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের বিষয়টি শুনেছি। শনিবার এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।