ডেস্ক,১৭ জুন: নারী সহকর্মীর গায়ে হাত দেওয়া, যৌন নিপীড়ন, কিশোরী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি, সন্ত্রাসী দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো –কোন অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে? তাঁর এক নারী সহকর্মী যেমন বললেন, ‘সে বলত, এই পোশাক ভালো না, চলো আমি তোমাকে পোশাক কিনে দেব, জুতা কিনে দেব। প্রায় দিনই সন্ধ্যায় সে আমাকে ফোন দিত। ফোন দিয়ে বলত, তোমাকে নিয়ে বলধা গার্ডেনে যাব, হাতিরঝিলে যাব, পার্কে যাব। তোমাকে ফোন দিলে তুমি চলে এসো। তার ফোন দেখলেই আমি আতঙ্কে থাকতাম।’
শুধু বলেই ক্ষান্ত নন তিনি। করেও দেখান। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ায় ক্ষমতা খাটিয়ে শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের অনেক কিছু করতে বাধ্য করেন।
আলোচিত এই শিক্ষকের নাম সরদার হেলাল উদ্দিন। তিনি রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এক শিক্ষিকা। এরপর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অভিযোগের পাহাড়।
ওই শিক্ষিকা বলেন, গত মার্চ মাসের ২১ তারিখে তিনি খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ওই সময় হিজাবসহ বোরকা পরতেন। কিন্তু স্কুলটিতে যোগদানের দিনই সরদার হেলাল উদ্দিন তাঁকে জানান, এই স্কুলে বোরকা পড়া যাবে না। তখন ওই নারী শিক্ষক খেয়াল করেন, স্কুলটির অন্য শিক্ষিকারাও বোরকা পরেন না। পরে তিনি বিষয়টি মেনে নেন এবং হিজাব-বোরকা ছাড়াই কাজ শুরু করেন।
স্কুল ছুটি হওয়ার পর ওই প্রধান শিক্ষক তিনজন শিক্ষিকাকে অকারণে বসিয়ে রাখতেন বলেও অভিযোগ করেন ওই নারী। তিনি বলেন, ‘আমাকে কোনো কাজ ছাড়াই বসিয়ে রাখত। বলত, আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি, আমাকে দেখতে এমন লাগছে। আমি যতদূর সম্ভব স্কুল ছুটির পর স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। তাঁর আচরণ সম্পর্কে স্কুলের দুজন শিক্ষিকাকে অল্প অল্প কিছু বলেছিলাম।’
ওই নারী বলেন, ‘১৩ জুন সকাল ১০টার সময় প্রধান শিক্ষক সরদার হেলাল উদ্দিন আমাকে ফোন দিয়েছে। ফোন দিয়ে বলেছে তোমার টাকা জমা দেওয়ার বইটা নিয়ে বের হও, তোমাকে নিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে যাব। কাজ শিখানোর জন্য বোর্ডে কীভাবে এসে কাজ করতে হয় তা শিখে যাও। শিক্ষা বোর্ডে যাওয়ার পথে রিকশায় করে শিক্ষা বোর্ডে নিয়ে যায়।’
তবে ফেরার পথে প্রধান শিক্ষক রিকশার হুড তুলে দেন জানিয়ে ওই নারী শিক্ষক বলেন, ‘আমি তাকে বলি স্যার হুড ওঠানোর দরকার নাই, আমি এভাবে বসতে পারছি না। রোদ নেই তবে কেন হুড উঠিয়ে দিচ্ছেন? রিকশায় কিছু দূর যাওয়ার পর সে আমার সাথে…। অনেক বাজেভাবে অশালীন আচরণ করেছে। সে আমার মোবাইলটাও হাতে রাখতে দেয় নাই, আমাকে জোরে চেপে ধরে রেখেছে। এমন সব বাজে বাজে কাজ করছিল, যা বলা অসম্ভব। এ সময় আমি লোকলজ্জার ভয়ে কিছুই বলতে পারছিলাম না। রিকশা থেকে নামার পর সে আমাকে বলে শুক্রবার আমাকে ফোন দিলে যেন আমি বের হই, সে আমাকে নিয়ে গাজীপুর যাবে। সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে আমাকে সময় কাটাতে হবে। সে বলে ১৭ লক্ষ টাকা দিয়ে জায়গা কিনে আমাকে দিবে।’
রিকশা থেকে নেমে বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মামলার সিদ্ধান্ত নেন ওই নারী। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে স্কুলের অনেক ছাত্রী বলেছে যে তার চরিত্র ভালো না। সব কিছু মিলিয়ে আমি ১৪ জুন মামলা দায়ের করেছি। এ সময় স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিল আমার সাথে। পিটি করাতে গিয়ে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া, পিঠে হাত দেওয়াসহ ক্লাস এর ভেতরেও সে অনেক খারাপ কাজ করেছে। অনেক শিক্ষার্থী এগুলো আমাকে বলেছে এবং অনেক শিক্ষার্থী এই সব ঘটনার বিষয়ে থানাতেও অভিযোগ করেছে।’
ওই নারীর মা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। গত বছর তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি একটি বুটিক শপে কাজ শুরু করেন। সেই সঙ্গে তাঁর বড় মেয়ে সংসার চালাতে অনেকগুলো টিউশনি করতে শুরু করেন। কয়েক মাস আগে এক ভাইয়ের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক সরদার হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয়। এরপর গত মার্চ মাসের ২১ তারিখে তাঁর মেয়েকে স্কুলটিতে যোগদান করতে বলেন সরদার হেলাল উদ্দিন। তবে সেখানে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাঁর মেয়ের ওপর ওই শিক্ষকের কুনজর পড়ে বলেও জানান ওই মা।
শিক্ষা বোর্ড থেকে ফেরার প্রসঙ্গে ওই মা বলেন, ‘কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার সময় সে রিকশায় উঠে আমার মেয়ের সাথে বাসায় আসার আগে পর্যন্ত যা ইচ্ছা করেছে। এমন আচরণ করেছে যা বলতে পারছি না, আবার বলে এমন হয় এতে মনে করার কিছুই নাই। আমার মেয়ে যখন বাসায় ঢুকছে তখন হতভম্ব হয়েছে এবং কান্নাকাটি করে বাসায় ঢুকেছে। আমি জিজ্ঞাস করেছি কী হয়েছে বল। বলে না শুধু কান্নাকাটি করে। অনেক পরে বলছে, হেলাল স্যার আমার সাথে আজ এই এই করেছে। এরপর আমি নিজে প্রধান শিক্ষককে ফোন দেই, ফোনে তাকে এত কিছু বলি কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয় না। ফোন কেটে দেয়, এরপর আমার ফোন আর ধরে না।’
ঘটনার পরের দিন ওই নারী শিক্ষকের মা স্কুলে গিয়ে অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রধান শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। শুধু আমার মেয়ে নয়, স্কুলের অনেক ছাত্রীদের সাথেই তাঁর এমন আচরণ। তাঁর বিচার হোক যেন অন্য কারো সাথে আর এমন না করতে পারে।’
স্কুলের মেয়েদের বুক ডাউন
সরদার হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবার নতুন নয়। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে যখন তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন না, তখনো তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে কিছু শিক্ষার্থী। অভিযোগে বলা হয়, ‘শারীরিক শিক্ষার ব্যবহারিক পরীক্ষার দিনে হেলাল স্যার আমাদের অত্যাচার করেছে। তিনি জানেন স্কুলের মেয়েরা বুক ডাউন দিতে পারে না, তাঁর পরেও তিনি মেয়েদের বুক ডাউন দিতে বাধ্য করেছেন। আমাদের এমন সব কাজ করিয়েছেন, তাতে ছয়জন ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার সরদার হেলাল স্যারের কঠোর শাস্তির আবেদন করছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, হেলাল উদ্দিন সব সময় ছাত্রদের বিভিন্ন অজুহাতে আতঙ্কের মধ্যে রাখেন। আর ছাত্রীদের নানা রকম অজুহাতে গায়ে হাত দেন। এমন অভিযোগ অনেকবার স্কুল কমিটির কাছে করা হয়েছে। সর্বশেষ খিলগাঁও থানায় উপস্থিত হয়ে তারা প্রধান শিক্ষকের কর্মকাণ্ডের কথা লিখিতভাবে জানিয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ
এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে খিলগাঁওয়ের স্থানীয়দের অনেক রকম অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করার চেষ্টাও করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্কুলের পাশের একটি বাড়ির এক বাসিন্দা বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের কর্মকাণ্ডের কথা আমরা এলাকবাসী সবাই জানি। তাঁকে এখান থেকে সরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদ করলেই তিনি কিছু মাস্তান দিয়ে নানা রকম ভয়-ভীতি দেখাতেন।’
স্কুল কমিটি ও সহকর্মীদের অভিযোগ
প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে স্কুল কমিটির একাধিক সদস্য কাছে নানা রকম অভিযোগ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘সরদার হেলাল উদ্দিনের নানা রকম অপকর্মের জন্য তাকে অনেকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে, ২০০৯ সালে অনেক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১০ সালের জুলাই মাসে তাঁর বরখাস্ত প্রত্যাহার চেয়ে তিনি একটি আবেদন করেছিলেন। ২০১১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা একটি লিখিত আবেদন করেছিল সরদার হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে।’
ছাত্রদের এমন অভিযোগের পর কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেলাল উদ্দিনের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়। এর জবাবে তিনি কমিটির কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চান বলেও জানান ওই সদস্য।
পুলিশের বক্তব্য
ঘটনা সম্পর্কে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, গত ১৪ জুন সরদার হেলাল উদ্দিনের নামে খিলগাঁও থানায় মামলা করেন ওই শিক্ষিকা। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
স্কুলের অন্য ছাত্রছাত্রীদের দায়ের করা অভিযোগ প্রসঙ্গে ওসি বলেন, ‘কয়েক জন ছাত্রছাত্রী থানায় এসে অভিযোগ দিয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সব কিছু শুনে আমরা ওই শিক্ষিকার দায়ের করা মামলাটি গ্রহণ করেছি এবং সরদার হেলাল উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছি।’