ঢাকা: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতালে জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক। আতঙ্ক থাকলেও মানুষের নিত্যদিনের সকল কাজই সম্পন্ন হচ্ছে। দিনে দূর পাল্লার গাড়িও চলছে। অফিস-আদালত-দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই ঠিক ঠাক চলছে। কিন্তু এই হরতালের বলি হচ্ছে কেবল শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের স্কুলগুলোতে ক্লাস হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে চাইলেও দায় নিচ্ছে না শিক্ষকরা। শিক্ষকরা বলছেন, ক্লাস করতে হলে তাদেরকে দায়মুক্তির আবেদন নিয়েই আসতে হবে। এসব কারণে আতঙ্কে অনেকেই স্কুলে যায় না।
রাজধানীর টিএন্ডটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার রিয়া ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আমরা ক্লাস করতে চাই। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরা হরতালে শিক্ষার্থীদের দায় নিতে চান না। তারা দায়মুক্তির আবেদন নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে আসতে বলেন। এ কারণে আমরা ক্লাসে যেতে ভয় পাই।’
জানতে চাইলে ঐ স্কুলের শিক্ষক হাফিজুর রহমান জানান, ‘হরতালে শিক্ষার্থীরা যদি ক্লাসে আসে। আর রাস্তায় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে? এসব কারণে আমরা দায় মুক্তির আবেদন নিয়ে ক্লাসে আসতে বলি।’ এই অবস্থা রাজধানীসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই।
তবে এবারের ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ১৫ লাখ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা শুরুর দিনেই হরতালের কবলে পড়তে হয়েছে কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীদের।
দুই ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেই পরীক্ষা হয়েছে ছয় ফেব্রুয়ারি। সর্বশেষ আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারির বৃহস্পতিবারের পরীক্ষাও হরতালের মধ্যে পড়েছে। এই পরীক্ষাও পেছানো হবে। শিক্ষাসচিব ড. নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আগামীকাল বুধবার।
বৃহস্পতিবার এসএসসিতে আট সাধারণ বোর্ডের অধীনে বিজ্ঞান/সাধারণ বিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত (তত্ত্বীয়), মাদ্রাসা বোর্ডে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা রয়েছে।
শুরু থেকে হরতালে বাধাগ্রস্ত হয়েছে ১০ দিনে মোট ২৭০টি বিষয়ের পরীক্ষা। এসএসসি ভোকেশনালে নতুন সিলেবাসের ট্রেড-২ (দ্বিতীয় পত্র) ৩১টি এবং পুরাতন সিলেবাসে ট্রেড-২ (দ্বিতীয় পত্র) আরও ৩১টি বিষয়ের পরীক্ষা রয়েছে। আর এসএসসি দাখিল রয়েছে ট্রেড-১ (দ্বিতীয় পত্র) এর ৩১টি এবং ট্রেড-১ (দ্বিতীয় পত্রে) মোট ৩১ বিষয়ের পরীক্ষা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা অবরোধের মধ্যেই বিভিন্ন দাবিতে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহের প্রতি কর্মদিবসে হরতাল পালন করছে বিএনপি জোট। হরতালের কারণে গত ২, ৪, ৮, ১০, ১২, ১৫, ১৮, ২২, ২৪ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়।
সপ্তাহের প্রতি কর্মদিবসে হরতালের কারণে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার পরীক্ষাগুলো গ্রহণ করা হচ্ছে। চলতি বছর ২৭ হাজার ৮০৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৬ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ের এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
হরতালে পরীক্ষা পেছানোর কারণে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও দুর্দশার কোনো শেষ নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে যেমন বেগ পেতে হচ্ছে, তেমনি সময়সূচি পরিবর্তনের কারণে খেই হারিয়ে ফেলছে অনেক পরীক্ষার্থী।
বরিশাল বোর্ডের মুক্তা নামে এক পরীক্ষার্থী ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ‘বার বার পরীক্ষা পেছানোর কারণে অনেক সময় রুটিন ভুলে যাই। কোন দিন কোন পরীক্ষা সেটিও খেয়াল থাকে না। এর বাইরে পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষতি তো আছেই।’
বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতালে ২০১৩ সালে এসএসসির ৩৭টি বিষয় এবং এইচএসসির ৪১টি বিষয়ের পরীক্ষা পেছানো হয়। ওই বছরের জেএসসি-জেডিসির ১৭টি বিষয় এবং প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীর দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হরতালের কারণে পিছিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত জেএসসি-জেডিসি এবং প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী পরীক্ষাও বিএনপির হরতালের কবলে পড়ে। হরতালে জেএসসি-জেডিসির চার দিনে নয়টি বিষয়ের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়।
চলতি বছরের এসএসসির লিখিত পরীক্ষা আগামী ১১ মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে হরতালের দিনের পরীক্ষা পিছিয়ে নেওয়া হয়েছে ৬ মার্চ। পরবর্তী পরীক্ষাগুলো আরও পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। আর এপ্রিলে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব ড. নজরুল ইসলাম খান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘পরীক্ষার্থীদের দুর্দশার আর শেষ নেই। বার বার পরীক্ষা পেছানো তাদের মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। প্রস্তুতির বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। আমরা বাধ্য হয়েই পরীক্ষা পেছানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বার বার অনুরোধ করার পরও তারা শুনছেন না।’