রাত থেকেই কালো মেঘে ঢাকা ছিলো ঢাকার আকাশ। সকাল আটটার পরে শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর পর বিকট শব্দে গর্জন। জনপ্রিয় সংঙ্গীত শিল্পী লাকী আখান্দের বিদায়েই হয়তো প্রকৃতির এমন আচরণ! কারণ শুক্রবার এই ক্ষণজন্মা সঙ্গীত শিল্পী লাকী আখান্দ অগণিত ভক্ত, স্রোতা ও শুভানুধ্যায়ীদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাকী আখান্দকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভক্ত, সহকর্মী ও সহযোদ্ধারা। অন্য সময়ের মতো এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
থেমে থেমে চলা বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রিয় শিল্পীকে বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে আসেন সরকারের মন্ত্রী, রাজনীতিবীদ, জনপ্রতিনিধি, শিল্পীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
সকলের মুখে ছিল লাকী আখান্দের সৃষ্টি ও কর্মের গুণগান। দাবি ছিল, তার গাওয়া সব গানগুলো যেন সংরক্ষণ করা হয়। শুধু শ্রদ্ধা নিবেদনেই যেন শেষ না হয় লাকী আখান্দকে স্মরণ। যুগ যুগ ধরে যেন তার সৃষ্টির চর্চা থাকে। যেন কোনোভাবেই হারিয়ে যায় তার অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
তবে অনেকে আবার জীবিত অবস্থায় এমন কীর্তিমানদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার অভিযোগও করেছেন। কেউ আবার সরকারের কাছে শিল্পীরা বেঁচে থাকতেই যেন সম্মানিত হন সে দাবি করেছেন। লাকী আখান্দের পরিবারের সদস্যসহ কয়েকজন সংঙ্গীতশিল্পীরা মেধাসত্ত্বের সম্মানি অর্থাৎ রয়েলিটি প্রদানের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারের দুই মন্ত্রী তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী লাকী আখান্দের শ্রদ্ধা নিবেদনের শুরুতে ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট রবীন্দ্র চাকমার নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এরপরই ফুলেল শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
এরপর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, সৈয়দ ইকবাল, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আনিসুর রহমান মল্লিক, সাধারণ জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী,সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা, সদস্য মেরিনা জাহান কবিতা, আওয়ামী লীগ নেতা শফী আহমেদ, মারুফা আক্তার পপি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, গণজাগরণ মঞ্চের নেতা কামাল পাশা চৌধুরী শ্রদ্ধা জানান।
সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে শিল্পী খুরশিদ আলম, ফকির আলমগীর, তিমির নন্দী, খোরশেদ আলম, নকীব খান, আসিফ ইকবাল, গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, গীতিকবি কবির বকুল, জলের গানের সাইফুল জার্নাল, লেখক নাট্যকার শাকুর মজিদ বেলাল খান, কাজী হাবলু, ফুয়াদ নাসের বাবু প্রমুখ।
এছাড়াও নাট্যসংগঠন প্রাচ্যনাট, শিল্পীত, ঋষিজ, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাসাস, খেলাঘর প্রভৃতি সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
আয়োজক সংগঠনের পক্ষে গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয়। এরপর এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
আসাদুজ্জামান নুর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন,‘যখন মানুষের শেখার বয়স তখন লাকী আখান্দ অন্যকে শিখিয়েছেন। বাংলা গানকে মানুষের অন্তরে স্পর্শ করাতে সক্ষম হয়েছেন। তার এই অর্জনকে আমরা সংরক্ষণ করতে চাই। সংরক্ষণের মধ্যে দিয়েই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবো। একজন শিল্পী, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধাকে চিরদিন এদেশের শিল্পী সমাজ মনে রাখবে। মনে রাখতে বাধ্য হবে।’
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বলেন, লাকী আখান্দের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। বর্তমানে তাকে খুব প্রয়োজন ছিলো। তবে তার গাওয়া সব গান সংরক্ষণ করার জন্য যা যা করার তাই করবো। তথ্য মন্ত্রণালয় আর্কাইভে তার গান সংরক্ষণ করা হবে।
শিল্পীদের মেধাস্বত্ত্ব সম্মানীর বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘এই আইনটি ত্রুটিপূর্ণ। এটাকে কীভাবে কার্যকর করা যায় সে ব্যাপারে আমরা পদক্ষেপ নেব।’
গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, লাকী আখান্দ সঙ্গীত জীবনের চমক। আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি। বয়স তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। রোগে শোকে তিনি অনেক দিন কষ্ট পেয়েছেন। গানের জীবনে তিনি নতুনত্বের স্বাদ এনে দিয়েছেন। ’
এসময় প্রত্যেক শিল্পীর মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘সরকার আসবে, সরকার যাবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতে পারে দেশের ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না।’
সঙ্গীতশিল্পী খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘লাকীর মতো শিল্পী চলে গেল, সেই ক্ষতিপূরণ হওয়ার মতো নয়। আর তরুণ গায়কদের বলব, তারা যখন লাকীর গান কোথাও গাইবেন, তখন যেন তাঁর নাম উল্লেখ করেন।’
কণ্ঠশিল্পী নকীব খান বলেন, ‘আধুনিক বাংলা গানের এক ভিন্ন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন লাকী আখান্দ। আমি তাঁর গান প্রথম শুনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। সে গানে অনুপ্রাণিত হই- কী গানে কী দেশপ্রেমে! সেই গানটি ছিলো ‘জন্মভূমি বাংলা মাগো। চলচ্চিত্র অঙ্গনের বাইরে এত জনপ্রিয় গান আর কেউ আমাদের উপহার দিতে পারেননি কিন্ত আমরা তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি।’
গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘আজ তাঁকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ স্থান শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানালাম। বিদায় জানালাম। আসলে তাদের কী বিদায় জানানো যায়! যায় না! এই লাল সবুজ পতাকার মতই তনি তিনি বেঁচে থাকবেন।’
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে লাকী আখন্দদের দ্বিতীয় ও সর্বশেষ জানাজা বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে সকাল ১০টায় পুরান ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে লাকী আখান্দের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন আশির দশকের সঙ্গীত শিল্পী লাখী আখান্দ। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাতে তাঁর মরদেহ হিমঘরে রাখা হয়।