বিশেষ প্রতিনিধি,৩ এপ্রিল ২০২৩:
আগামী জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা উঠে যাচ্ছে। সুদহার কতটুকু পর্যন্ত নির্ধারণ করা যাবে, তার নতুন পদ্ধতি চালু হবে। ছয় মাস মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের পূর্ববর্তী ছয় মাসের গড় সুদহারের সঙ্গে দেওয়া হবে ৩ শতাংশ ‘করিডোর’।
এতে করে বর্তমানের তুলনায় সুদহার বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে ব্যাংকার্স সভায় এ তথ্য তুলে ধরে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। আইএমএফের ঋণের শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্যাংকারদের জানানো হয়, ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে বা কমলে তখন করিডোরেও পরিবর্তন আসবে। এভাবে প্রতি মাসে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার এবং করিডোর ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো তার ভিত্তিতে গ্রাহকদের জন্য সুদহার ঘোষণা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির নেতারা উপস্থিত থাকলেও বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র কিছু তথ্য দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করার পাশাপাশি ডলারের যে অনেকগুলো দর আছে শিগগিরই তা কাছাকাছি হবে। এ ছাড়া বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমানো এবং ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ক্যাশলেস লেনদেন বাড়লে তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ কমবে।
বৈঠকে উপস্থিত একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, গভর্নর জানিয়েছেন, আগামী মুদ্রানীতিতে নতুন পদ্ধতির সুদহার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। ব্যাংকগুলো যেন আগাম প্রস্তুতি নিতে পারে, সেজন্য এখন একটি ধারণা দেওয়া হলো। বৈঠকে ডলার বাজার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। গভর্নর বলেছেন, ঘোষণার চেয়ে কোনো ব্যাংক বেশি দরে ডলার কেনাবেচা করলে ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শাস্তির আওতায় আসবেন।
মতামত জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার স্বাধীনভাবে ওঠানামা করে না। কেননা, বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাংক বেশি রেট দিলে তা বাতিল করে (ডিভল্বমেন্ট) কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ সরবরাহ করে। আবার করিডোর হতে হয় নির্ধারিত, যা বাড়ানো বা কমানো যৌক্তিক নয়। ফলে সুদহারের নতুন পদ্ধতি পুরোপুরি বাজারভিত্তিক বলা যাবে না। তিনি বলেন, এখন ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা আছে। নতুন পদ্ধতিতে তা বেড়ে হয়তো ১০ শতাংশের আশপাশে রাখা হবে। এমন না করে সত্যি সত্যি বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে পারলে ভালো। আবার ক্ষুদ্র পর্যায়ে ঋণ বিতরণে খরচ বেশি। সে ক্ষেত্রেও যদি একই রকম ব্যবস্থা যৌক্তিক হবে না।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সুদহার হিসাবের নতুন পদ্ধতিকে বলা হবে, স্মার্ট (শর্ট টার্ম মুভিং এভারেজ রেট)। এর সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ৩ শতাংশ করিডোর যোগ করে সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারিত হবে। ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গতকাল ছয় মাসের গড় সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ যোগ করলে সুদহার ১০ শতাংশের নিচে থাকে। নতুন পদ্ধতি চালু হলে একটি ব্যাংক সর্বোচ্চ ওই পর্যায়ে সুদ নিতে পারবে। চাইলে এর নিচেও রাখতে পারবে। আবার ‘স্মার্ট রেট’ বাড়লে তখন ‘করিডোর রেট’ কমবে। অন্যদিকে, কমলে করিডোর বাড়ানো হবে। এর মানে ঘুরেফিরে সুদহার প্রায় একই রকম থাকবে। যে কারণে নতুন এ সুদহারও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে না।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম বলেন, সুদহার অনেক বাড়লে ব্যবসা করা কঠিন হবে। এর আগে একসময় সুদহার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে উঠে যাওয়ায় খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছিল। তাই বলে সীমা আরোপ করে রাখাও ভালো কিছু নয়। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিতে হবে পুঁজিবাজার থেকে। তবে আমাদের এখানে কেন যেন মানুষ ব্যাংক থেকেই সব ধরনের অর্থায়ন নেয়।
রপ্তানির তথ্যও তদারকির সিদ্ধান্ত: বর্তমানে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হয়। আর অন্য সব এলসির তথ্যও তদারক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যের দর সঠিক দেখানো হচ্ছে কিনা তাও তদারকি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, স্বাভাবিক সময়ের মতো এখন দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার আমদানি এলসি খোলা হচ্ছে। তবে আমদানিতে দর বেশি বা কম দেখানোর প্রবণতা কমেছে। আগামীতে রপ্তানির ক্ষেত্রে সঠিক দর দিচ্ছে কিনা, তদারক করা হবে। কেউ পণ্যের দর কম দেখিয়ে দেশের বাইরে অর্থ রাখলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোয় জোর: বৈঠকে গভর্নর জানান, অর্থ পাচারের বড় অংশই হয় বাণিজ্যের আড়ালে। এখন দর বেশি বা কম দেখানো বন্ধ করার মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকানো গেলে হুন্ডির চাহিদা এমনিতেই কমবে। এভাবে হুন্ডি চাহিদা কমানো গেলে তখন বৈধ চ্যানেলে আয় এমনিতেই বাড়বে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ডলার কেনাবেচায় অনিয়ম নিয়ে সতর্ক বার্তা: এক রকম ঘোষণা দিয়ে আরেক দরে ডলার কেনাবেচায় জড়িত ব্যাংকারকে ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। ব্যাংকার্স সভা শেষে বেশি দরে ডলার বেচাকেনায় যুক্ত বেসরকারি খাতের ১০ ব্যাংকে নিয়ে আলাদা বৈঠক হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়। এ ছাড়া যারা ঘোষণার চেয়ে বেশি দরে কেনাবেচা করেছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থার কথা জানানো হয়।