সাব্বির নেওয়াজ ও ফসিহ উদ্দীন মাহতাব:
মোছা. রাবেয়া সুলতানা ,যশোর জেলার শার্শা উপজেলার নাভারণ বেরি নায়াণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। তার স্বামীও খুলনা মহানগরীতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা। স্বামীর চাকরির সুবাদে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার স্কুলে শূন্য পদে বদলির জন্য যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে আবেদন জানান তিনি। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী তার নামও আগে ছিল। কিন্তু তাকে নয়- বরং বদলি করা হয়েছে একজন জুনিয়র সহকারী শিক্ষককে।
এমনকি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অন্যান্য বিভাগে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা শূন্য পদের তালিকা দিলেও সেসব প্রার্থীকে বদলি করা হয়নি। মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশও আমলে আনা হয়নি। জ্যেষ্ঠ না হওয়ার পরও শিক্ষক বদলিতে এ বছর অর্থের বিনিময়ে দালাল চক্র ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। যারা দালালদের সঙ্গে রফা করতে পেরেছেন, তারাই পছন্দের বিদ্যালয়ে বদলি হতে পেরেছেন। এসব দালালের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে। বদলি প্রক্রিয়া নিয়ে খোদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বদলি নিয়ে চারিদিকে ওঠা তীব্র সমালোচনা সামাল দিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) যুগ্ম সচিব জসীম উদ্দিনকে তার পদ থেকে সম্প্রতি সরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তাকে সরিয়ে দেওয়ার পরও গোপনে একাধিক বদলি আদেশ জারির ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দিন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, বদলি হতে আগ্রহীরা ভিড় জমিয়েছেন। অনেকে মহাপরিচালকের কক্ষে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন। অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটররা শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। শিক্ষকদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, যারা টাকা দিতে পেরেছেন, তাদের কাজ হচ্ছে।
বদলির সময় তো পার, তা হলে কেন ভিড় করছেন?- এ কথা জানতে চাইলে তারা বলেন, এখনও বদলি হচ্ছে। ৩১ মার্চের তারিখ দিয়ে বদলি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে রহস্যজনক কারণে আপলোড করা হচ্ছে না।
ঘুরতে ঘুরতে হয়রান :সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলিতে বিদ্যমান নীতিমালা মানার কথা থাকলেও তা এবার পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষকরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মহাপরিচালক বরাবর নির্দিষ্ট ফরম্যাটের কাগজেই আবেদন করেছেন। একই উপজেলার মধ্যে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে কেউ বদলি হতে চাইলে সেটা করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। একই জেলার মধ্যে বদলির ক্ষেত্রে তা করেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। এক বিভাগের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জেলার ক্ষেত্রে বদলি করেন বিভাগীয় উপপরিচালক। এ ছাড়া, এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে এবং মফস্বল থেকে মহানগরে বদলি করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। রাজধানীর ক্ষেত্রে অধিদপ্তর শিক্ষকদের বদলি করলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এসব বদলিতে দিনের পর দিন ঘুরতে হচ্ছে শিক্ষকদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এভাবে বদলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না। বরং প্রতিটি ধাপে শিক্ষকরা হয়রানির শিকার হন। পাশাপাশি এক শ্রেণির অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির আবেদনকারীদের কাছ থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেন। বিদ্যমান এ ব্যবস্থায় বদলির আবেদনের পর শিক্ষকরা ধরনা দেন সংশ্নিষ্ট শিক্ষা অফিসে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বা ক্লাস বন্ধ করে শিক্ষকদের দিনের পর দিন, কখনও মাসের পর মাস উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কার্যালয়, উপপরিচালকের কার্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ধরনা ও তদবির করতে হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বদলির তুলনায় মেট্রোপলিটন সিটি ও এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলির ক্ষেত্রে হয়রানির ঘটনা বেশি। বদলির অনুমোদন করাতে অনেক ধাপে টাকা দিতে হয়। মেট্রোপলিটন সিটি ও এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে বদলির ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আবেদন করতে হয় মহাপরিচালক বরাবর। এ জন্য তাদের বিভিন্ন টেবিলে ধরনা দিতে হয়। এক কর্মকর্তার টেবিলে নূ্যনতম তিনবার নথি চালাচালি করতে হয়। এই প্রক্রিয়া মেনে বিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে দিনের পর দিন টেবিলে টেবিলে ছুটে চলছেন শিক্ষকরা। সংশ্নিষ্ট অফিসের বিভিন্ন স্তরে টাকা দিতেও বাধ্য হচ্ছেন।
বদলি প্রক্রিয়া জটিল :শিক্ষকরা জানান, দুর্নীতি-অনিয়ম করতে ইচ্ছাকৃতভাবেই বদলির প্রক্রিয়া জটিল করে তোলা হয়েছে। অথচ তা আরও সহজ করা যেত। কোনো শিক্ষক যদি এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে, অথবা রাজধানীতে শূন্য পদে প্রাপ্যতা অনুযায়ী বদলি হতে চান, তবে তার আবেদনপত্রে প্রধান শিক্ষক, উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে জমা দিতে হয়। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবেদনের ফাইল সুপারিশসহ বিভাগীয় অফিসে পাঠান। এরপর বিভাগীয় অফিস থেকে আবেদনটি অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এ পর্যায়ে শূন্য পদ নিশ্চিত করে ওই পদের বিপরীতে বদলির অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
‘সিন’ মন্তব্যসমেত মহাপরিচালক ফাইলটি পরিচালকের (পলিসি ও অপারেশন) টেবিলে পাঠান। একই মন্তব্যসহ ফাইলটি পর্যায়ক্রমে যায় উপপরিচালক (বিদ্যালয়), সহকারী পরিচালক (পলিসি) ও শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। আবেদনকারী শিক্ষক যে জেলায় বদলি হতে চান, সেই জেলার সংশ্নিষ্ট বিদ্যালয়ের শূন্য পদে বদলির জন্য শূন্য পদ চাওয়া হবে কি-না, তার অনুমোদন চেয়ে ওই শিক্ষা কর্মকর্তা এবার ফাইল পাঠিয়ে দেন সহকারী পরিচালকের (পলিসি) কাছে। তিনি ফাইলটি ফরোয়ার্ড করেন উপপরিচালকের (বিদ্যালয়) কাছে। উপপরিচালক ফাইল পাঠান পরিচালকের (পলিসি ও অপারেশন) কাছে। তিনি শূন্য পদ চাওয়ার অনুমোদন দিয়ে ফাইলটি ফরোয়ার্ড করেন সহকারী পরিচালকের (পলিসি) কাছে। সহকারী পরিচালক (পলিসি) ফাইলে অনুমোদন দিয়ে চিঠি পাঠান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি আবার সংশ্নিষ্ট উপজেলাকে চিঠি দিয়ে শূন্য পদের অনুমোদন চান। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শূন্য পদ নিশ্চিত করে বদলি করা যেতে পারে জানিয়ে চিঠি দেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার চিঠিসহ মহাপরিচালকের দপ্তরে সরাসরি ফাইল পাঠিয়ে দেন। এরপর বদলি ও পদায়ন করার আদেশ জারির অনুমোদন হলে পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) সেই আদেশ জারি করেন।
নিয়ম-নীতি না মেনেই বদলি :বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) শুধু প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। গত ৩১ মার্চ ছিল বদলির শেষ দিন। শেষ দিন পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই ২০০ শূন্য পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষক বদলির আবেদন করেন। খুলনা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও আবেদন জমা পড়েছিল কয়েক হাজার। কয়েক ধাপে এসব বিভাগে বদলি করা হয়। গত ৩১ মার্চ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) পরিচালক খান মো. নুরুল আমিনের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে চট্টগ্রামের জেলা শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ২৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরও তিনটি আলাদা আদেশে দ্বিতীয় দফায় ঢাকার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৫ জন সহকারী শিক্ষককে বদলি করা হয়েছে। এসব আদেশে বলা হয়, শূন্য পদের বিপরীতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকদের বদলি করা হলো। তাদের নিজেদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ জারি করায় বদলি শিক্ষকরা কোনো ভ্রমণ ভাতা পাবেন না। আদেশে আরও বলা হয়, ডিপিই মহাপরিচালকের অনুমোদনের পর এ আদেশ জারি করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে তাদের বদলিকৃত স্কুলে যোগ দিতে হবে।
খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অন্যান্য বিভাগের ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানান, কয়েকটি বিদ্যালয়ে শূন্য আসন সাপেক্ষে তারা সম্মিলিতভাবে বদলির আবেদন করেছিলেন। পরে ডিপিই অফিসে মহাপরিচালকের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করলে তিনি তাদের শূন্য পদের তালিকা আনতে বলেন। যাদের আবেদনের সঙ্গে শূন্য পদের তালিকা থাকবে, বদলির জন্য তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন মহাপরিচালক।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানান, জেলা শিক্ষা অফিস থেকে শূন্য পদের তালিকা এনে জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করে ডিপিইতে জমা দিলেও তাদের বদলি করা হয়নি। আবার অনেকের আবেদনও গায়েব হয়ে গেছে। কোনো কোনো শিক্ষককে আবেদন করতেই দেখা যায়নি, অথচ তারা রহস্যজনকভাবে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে বদলি পেয়েছেন। কেউ কেউ যে প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের নাম প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন, তাকে সেখানে না দিয়ে অন্য বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, অর্থের বিনিময়ে বদলি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা এমন কথা বলছেন, তারা সঠিক বলছেন না। নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেই শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। একই প্রতিষ্ঠানে বদলি হতে আগ্রহী দু’জন শিক্ষক আবেদন করলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বদলি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আবেদনকারীর ফাইল গায়েব হয় না, আগে আবেদন করায় অনেক সময় ফাইল হয়তো খুঁজে পাওয়া যায় না। বদলির ক্ষেত্রে ব্যক্তির প্রয়োজন এবং মানবিক কারণকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সুত্র: সমকাল