প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্য জাতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে

বাংলাদেশে বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অনেক পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এসব পরীক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। আর পরীক্ষা নিয়ে এখানে একধরণের ব্যবসা হচ্ছে। বহু বাণিজ্যের মতো এদেশে পরীক্ষাও একধরণের বাণিজ্য।

রেডিও তেহরানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড.মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে আসলে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, সমাজ এবং ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ের মতলববাজদের দ্বারা নকল এবং প্রশ্ন ফাঁসের যে পরিস্থিতি তাতে জাতি একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ

পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো

রেডিও তেহরান: জনাব মাহবুব উল্লাহ, বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, জুনিয়র এমনকি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় নকলের ছড়াছড়ি চলছে। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই যতসব অভিযোগ। যেখানে প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাবে সেখানে উল্টো চিত্র। এর কারণ কি?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: দেখুন বাংলাদেশে একসময় মহামারীর মতো পরীক্ষায় নকল হত। তবে সেই নকলের বিরুদ্ধে একসময় ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। এরফলে পরবর্তীতে আমরা লক্ষ্য করলাম এস এস সি এবং এইচ এস সি পরীক্ষায় নকল প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আবারও সেই পুরনো অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস।

বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অনেক পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। পঞ্চম, অষ্টম, দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে তাদেরকে পরীক্ষা দিতে হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা তো আছে। এসব পরীক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ফলে সাধারণত পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন পাওয়া যায়। একশ্রেণীর দুষ্টুচক্রের হাতে গিয়ে পৌঁছায় এসব প্রশ্নপত্র। তারা এই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বাজারজাত করে। অর্থাৎ পরীক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করে। বলতে গেলে এখানে পরীক্ষা নিয়ে একধরণের ব্যবসা হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেকরকম বাণিজ্য আছে যেটা সভ্য কোনো দেশে নেই, যেমন- ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য এবং বদলি বাণিজ্য এসব নানাধরণের বিষয় রয়েছে। আর এরসঙ্গে নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হয়েছে পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে বাণিজ্য। অর্থাৎ এখানে যতরকম অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করা যায়, ধনাগম করা যায় সেই ধরণের অবস্থা বাংলাদেশে আমরা বর্তমানে লক্ষ্য করছি।

আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন, রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি প্রতিহত করার জন্য বা যাতে এটা আর বিস্তার লাভ করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি না! আসলে এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

যেমন প্রাথমিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী আছেন তাকে মিডিয়ার পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, এ ধরণের কোনো খবর তিনি জানেন না। জানলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। আমরা আরো লক্ষ্য করি এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। এর সবচেয়ে খারাপ ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া যেটা হচ্ছে সেটা হচ্ছে সদ্ভাবে একাগ্রতা নিয়ে যারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা যখন দেখে অন্যরা প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছে এবং এরফলে তারা ভালো নাম্বার পাচ্ছে তখন তাদের মধ্যে একধরণের হতাশা সৃষ্টি হয়। এ কারণে আস্তে আস্তে কোমলমতি ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়ে বা শিক্ষা বিমুখ হয়ে পড়ে। এতে করে একটা জাতির জন্য শিক্ষা বিমুখতার অবস্থা সৃষ্টি হয়। আর এই অবস্থা যে কত বিপজ্জনক তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। আর ঠিক সেই অবস্থাটাই আমাদের দেশে হচ্ছে।

রেডিও তেহরান: নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। তো এ পর্যন্ত তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাকে কি যথেষ্ট বলা যায়?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: না, নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রী এ পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তাকে আমি কোনোভাবেই যথেস্ট বলব না। যেটি করা হয়েছে বা বলা হচ্ছে সেটা সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার একটা চেস্টামাত্র। আর এভাবে সমস্যাকে এড়িয়ে যেতে থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ভাবনার জন্ম নেবে যে তারাও হয়তো এই অপরাধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ফলে তাদেরকে এ ব্যাপারে অবশ্যই কিছু করতে হবে।

রেডিও তেহরান: প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বৃহস্পতিবার বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ওপর গজব নেমে আসবে। অনেকটা অসহায়ত্ব ফুঁটে উঠেছে মন্ত্রীর এ বক্তব্য থেকে। কি বলবেন আপনি এ বক্তব্য সম্পর্কে?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: মন্ত্রীর এ বক্তব্য আসলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা। আমাদের দেশে মানুষ যখন খুব অসহায় হয়ে যায়, অত্যাচারী, নিপীড়ক, বঞ্চনাকারীর ব্যাপারে রাষ্ট্রের কাছ থেকে যখন কোনো প্রতিবিধান পায় না; তখন মানুষ ভাগ্যের কাছে বা নিয়তির কাছে আত্মসমর্পন করে। শিক্ষামন্ত্রীও তাই করেছেন। পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা তার হাতে নেই।

রেডিও তেহরান: বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকলের সঙ্গে অনেক স্কুলের শিক্ষক জড়িত। অনেক শিক্ষক আবার অভিযোগ করছেন, স্কুল ও ছাত্রছাত্রীদের রেজাল্ট ভালো করার বিষয়ে তাদের ওপর চাপ আছে। এছাড়া, বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে- প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকলের মাধ্যমে জাতিকে মেধাশূন্য করার চক্রান্ত চলছে। কি বলবেন এসব অভিযোগ সম্পর্কে?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: আপনি প্রশ্নের মধ্যে যে তিনটি অভিযোগের কথা বললেন তার সবগুলোই সত্য। প্রথমত আমাদের দেশে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব চরমভাবে কাজ করে। দলীয়প্রভাব কাজ করে চরমভাবে। যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয় তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা এবং নৈতিকতা সম্পর্কে কোনো বাছবিচার করা হয় না।ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষকদের মধ্যে একটা অংশ অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে স্কুলগুলোর ওপর চাপ দেয়া যে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। আমরা অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমরা এটাকে বলি নেগেটিভ ইনসেনটিভ সৃষ্টি করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভালো কিভাবে করা যাবে। ভালো দু’ভাবে করা যায় একটা হলো ভালোভাবে পড়িয়ে তাদেরকে ভালোভাবে প্রস্তুত করিয়ে ভালো ফলাফল করানো যায়।

আরেকটি খুব সহজপথ। অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যোগাড় করে ছাত্রদের হাতে পৌঁছে দিয়ে ফল ভালো করানো। এতে আরো একটি সুবিধা আছে সেটা হচ্ছে এরমাধ্যমে কিছু টাকা পয়সাও পাওয়া যায়। ফলে এতে দুটো উদ্দেশ্য সাধন হয়। ভালো ফলও দেখানো যায় একইসঙ্গে কিছু অর্থও পাওয়া গেল। এই দুটো উদ্দেশ্য পূরণ হলো। এই ধরণের নেতিবাচক যে প্রণোদনা সৃষ্টি হয় সেটা একটা দুষ্টুচক্রের মতো কাজ করে।

রেডিও তেহরান: একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আপনি কি একটু বলবেন, নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধের জন্য আসলে কার্যকর কি পদক্ষেপ নেয়া যায়?

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: আমার কাছে প্রথমে যেটা মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যায়ে পরীক্ষা নেয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেটা আমাদের রয়েছে কি না!

দ্বিতীয়ত হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না; এর গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে তার জন্য সতিক্যকারের কোনো প্রস্তুতি আছে কি না? এটা একটা খুব বড় বিষয়।

তৃতীয়ত ১৬ কোটি মানুষের দেশে বহু মতলববাজ লোক থাকে। আর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো সমাজের বা ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ে এ ধরণের লোক থাকে তখন এ ধরণের বিপদ থেকে মুক্ত থাকা খুব কঠিন হয়ে যায়। তো সেই পরিস্থিতিতে আমরা একটা ভয়াবহ সংকটের মধ্যে আছি। জাতি একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটাকে প্রতিরোধ করার জন্য নানা জনে নানা কথা বলে থাকে। আমি সম্প্রতি মিডিয়াকে বলেছি এর বিরুদ্ধে বড় ধরণের সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা ছাড়া আমাদের হাতে আর অন্য কোনো কৌশল বা সুযোগ নেই। এখন যারা প্রকৃত শিক্ষাবিদ, যারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক; এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভালোবাসেন তাদেরকে ব্যপক জনমত গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। জনমতের শক্তি দিয়েই এটাকে রোধ করতে হবে। আইআরআইবি

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।