- এই অশুভ ঘটনায় সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান
- অটোমোশন পদ্ধতি চালু করে চিরতরে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার
- জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে
- হোতা শনাক্তে তৎপর গোয়েন্দারা
বিভাষ বাড়ৈ/গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষা খাতের ক্যান্সার হয়ে দেখা দিয়েছে। এই অশুভ ঘটনা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে। সম্প্রতি অন্তত ৮৩ বার বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। এতে শুধু সরকারই বিব্রত হয়নি, বিপাকে পড়েছে লাখো শিক্ষার্থী। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা চিরতরে বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য চলছে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা। এই পদ্ধতিতে পা-ুলিপি থেকে নির্বাচিত প্রশ্নপত্র সরাসরি ছাপার জন্য প্লেট আকারে তৈরি হয়ে যাবে। কয়েক ধাপে প্রশ্নপত্র তৈরির প্রয়োজন হবে না। এতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা কমে যাবে। এছাড়া পরীক্ষা শুরুর ২ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত কার্যকরের নানাদিক নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা চলছে। সেইসঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসের হোতাদের শনাক্ত করতে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পাশাপাশি বিজি প্রেসসহ সরকারী ছাপাখানাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র হস্তান্তরের পরই ফাঁসের ঘটনা ঘটছে বলে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর এবং বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। ২০১০ সালের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কারও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি বলেও দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হালনাগাদ অন্তত ৮৩ বার বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রথম ব্যাপক আলোচনায় আসে। ওই ঘটনায় প্রথম তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়। হালনাগাদ বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অন্তত ৩৩ বার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি যথারীতি রিপোর্টও দিয়েছে। কিন্তু সেসব রিপোর্টে কমিটির সুপারিশ অধিকাংশই কার্যকর হয়নি।
সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণীর গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ কারণে উপজেলাটির ৪০টি উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আগামী ১৫ ডিসেম্বর স্থগিত হওয়া পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার তদন্ত চলছে। প্রায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তবে আগের মতো আর ঢালাওভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে না।
২০১০ সালের ৮ জুলাই রংপুরে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং ভুয়া পরীক্ষার্থীর কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেটিই ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতরা ভিন্নজগত নামে একটি বেসরকারী বিনোদন কেন্দ্রের তিনটি কক্ষ ভাড়া নেয়। সেখানে পরীক্ষার্থীদের আগাম পরীক্ষা নেয়ার সময় ৫ দালালসহ ১৬৭ জন পুলিশের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন পরীক্ষার্থী ছাড়াও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী হামিদুল হক, বিজি প্রেসের কর্মচারী, কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমান ও পটুয়াখালী সদর উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবুল বাশারসহ বিজি প্রেসের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী। গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় গবর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও বিজি প্রেসের বাইন্ডার লাবণী বেগম, পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম এ রউফ।
গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, বিজি প্রেসের ভেতর থেকে ট্রাঙ্কে রাখা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দেয়া ২৮ লাখ টাকাসহ বিজি প্রেসের কর্মচারী আব্দুল জলিল গ্রেফতার হয়। ঘটনার দীর্ঘ তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গোপনীয় শাখাসহ পুরো বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ত্রুটির চিত্র উঠে আসে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনেও জানানো হয়, বিজি প্রেসের প্রধান ফটক ও গোপনীয় শাখায় প্রবেশ ও বহির্গমনে কোন তল্লাশি না থাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি ঘটে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই একজন কর্মচারী অনায়াসে একটি ট্রাঙ্কে করে ২৮ লাখ টাকা নিয়ে বিজি প্রেসে ঢুকতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিজি ও জিপি প্রেসের চক্রটিই সব সময় প্রশ্ন বের করে আনা-নেয়ার দায়িত্ব পালন করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে পিএসসি ও বিজি প্রেসের অন্তত ১০ কর্মকর্তা। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমল থেকেই এই চক্রের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে পিএসসির বিতর্কিত সদস্য ড. মাহফুজুর রহমান ও তাঁর দুই ভাগ্নেসহ কয়েক পরিচালক কাজ করছিলেন। তাঁদের যোগসাজশেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছিল। এজন্য বিজি প্রেসের সার্বিক নিরাপত্তায় এপিবিএন’র (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) ৬২ সদস্যের সমন্বয়ে একটি বিশেষ নিরাপত্তা সেল গঠনসহ বিজি প্রেসের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দেয়া হয়েছিল ওই বিশেষ প্রতিবেদনে।
বিজি প্রেস সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বিজি প্রেসের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। প্রবেশপথগুলোতে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। গোপনীয় শাখার প্রবেশপথে বসানো হয়েছে পেপার ডিটেক্টর। গোপনীয় শাখার মুদ্রিত প্রশ্নপত্র সিলগালা করে রাখতে নতুন স্ট্রংরুম তৈরি করা হয়েছে। ছাপাকৃত সকল প্রশ্নপত্র স্ট্রংরুমে রাখা হচ্ছে। বিজি প্রেসের মনিটরিং সেলের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা সেলের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্র স্ট্রংরুমে সিলগালা করা হয়ে থাকে। মূল গেট বন্ধের পর সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশের নিরাপত্তা রয়েছে। পুরো বিজি প্রেস সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিশেষভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে গোপনীয় শাখার কার্যক্রম। গোপনীয় শাখায় কর্মরতদের পুরো শরীর তল্লাশি করে ঢুকতে দেয়া হয়। বের হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো শরীর তল্লাশি করা হবে। তাদের কোন অন্তর্বাস ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। পকেটহীন নীল রঙ্গের পোশাক ব্যবহার করতে হয়। ট্রাউজারে কোন বেল্ট বা পকেট থাকে না।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ২০১০ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কঠোর নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশের পরই বিজি প্রেসের প্রশ্নপত্র শাখাকে অন্য মুদ্রণ শাখা থেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা হয়। এমনকি প্রশ্নপত্র ছাপার গোপনীয় শাখা পুরোপুরি মূল প্রেস ভবন থেকেই আলাদা করা হয়। প্রশ্নপত্র শাখায় বসানো হয় মেটাল ডিটেক্টর, পেপার ডিটেক্টর, ভল্ট ডোর, ক্যামকোর্ডার, গোপন ক্যামেরা আর পর্যাপ্ত সিসিটিভি। গোপনীয় ইউনিটের প্রবেশপথ ও বিজি প্রেসের সাধারণ শাখার আলাদা আলাদা প্রবেশপথও তৈরি করা হয়।
বিজি প্রেসের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্ত প্রতিবেদন মোতাবেক বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে ২০১০ সালের পর হালনাগাদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কারও জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। ৩২টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপার গোপন শাখা সব সময় মনিটরিং করা হয়। প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর জেলা বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাদের আর কোন দায়িত্ব থাকে না। সেখান থেকেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা বেশি থাকে।
তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত থাকেন। এসব প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এতে করে প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়া সহজ হবে। অনেক শিক্ষক বা প্রশ্নপত্র প্রণেতা বা অন্যদের অংশগ্রহণ কমে আসবে। পা-ুলিপি থেকে নির্বাচিত প্রশ্ন সরাসরি অটোমেশন পদ্ধতিতে প্লেট আকারে তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এতে গোপনীয়তা রক্ষা করা অনেক সহজ হবে। কয়েক হাত ঘুরে প্রশ্নপত্র তৈরির জটিলতা থাকবে না। যত হাত ঘুরে প্রশ্নপত্র তৈরি হবে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা তত বেশি থাকে। তাই অটোমেশন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়া চালু হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। এছাড়া পরীক্ষা শুরুর ২ ঘণ্টা আগে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানোর প্রস্তাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা বা থানা থেকে প্রশ্নপত্রগুলো সরবরাহ করার প্রক্রিয়া ও কার্যকারিতার বিষয় নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা চলছে।
তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের বিশেষ নিরাপত্তা সেল গঠিত হয়নি। তবে মিরপুর পুলিশ লাইন ও আনসারের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় ৬০ সদস্যের একটি দল নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
এরপর ২০১২ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও সরকারী চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিদর্শক মফিজুর রহমান মফিজ (৩৫) ১০ সহযোগীসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি আবারও ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। সহযোগীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক ঘড়ি সদৃশ ২০ মোবাইল ফোন ঘড়ি। গ্রেফতারকৃত চক্রটির সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে প্রকাশ পায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হালে প্রশ্নপত্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও কর্মচারীদের মাধ্যমে মূলত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বেশি ঘটছে। পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্রের বান্ডেল খোলা হয়। এ সময় দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বা কর্মচারীর মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন দিয়ে প্রশ্নপত্র স্ক্যান করা হয়। এরপর স্ক্যান করা প্রশ্নপত্র ই-মেইলের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের অপর সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। তারা ভাল ছাত্রদের দিয়ে প্রশ্নের সমাধান করে। এরপর সমাধান করা উত্তর এসএমএসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের হাতে থাকা বিশেষ ডিভাইসযুক্ত হাতঘড়ি সদৃশ মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও সরকারী বিজ্ঞান কলেজ, ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিটি কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ, সরকারী তিতুমীর কলেজ ও বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। সিন্ডিকেটটি ২০০৯ সাল থেকে সক্রিয়। চক্রটির হাত ধরে সরকারী চাকরি পেয়েছেন অন্তত ৫ হাজার। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শুধু প্রশ্নপত্র আনা-নেয়ার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। আনা- নেয়ার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন আশঙ্কা নেই। তারপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর প্রত্যেকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু সব প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসে না। যেসব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ঢালাওভাবে ফাঁস হয় শুধু সেসব খবরই প্রকাশ পায়। একটি প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে বহু লোক জড়িত থাকেন। অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রশ্নপত্র তৈরি হয়ে থাকে। প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত একাধিক কমিটি রয়েছে। প্রথমে প্রশ্নের খসড়া তৈরি হয়। এরপর বিভিন্ন হাত ঘুরে জমা হয় অধিদফতরে।
তিনি বলেন, হয়তো কোন প্রশ্নপ্রণেতা দশটি প্রশ্নের প্রস্তাব করেন। তার মধ্যে হয়তো একটি প্রশ্ন মূল প্রশ্নপত্রে জায়গা পায়। এভাবেই একেকটি প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। সমস্ত প্রশ্নপত্র এসে জমা হলে তা আলাদ স্ট্রংরুমে রাখা হয়। সেখান থেকে প্রশ্নপত্রগুলো নানা বিষয় অনুযায়ী পৃথক করে সিলগালা করা হয়। পরে তা রাখা হয় স্ট্রংরুমে। এরপর ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিরাপত্তার কারণেই একাধিক প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করা হয়ে থাকে।
মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম মঞ্জুরুল হক প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালের পর প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও তাদের অধিদফতরের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। ২০১০ সালের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কোন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্রুত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কারা জড়িত তা বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা জাতির মেরুদ- দুর্বল করে দিচ্ছে। তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এরা দেশদ্রোহী। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। অন্যথায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত বিসিএস, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, অডিট, এনবিআর, এটিইও, মেডিক্যাল, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, এসএসসি, এইচএসসি, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রায় ৩০ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার অভিযোগ ওঠে। প্রসঙ্গত, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বেআইনী বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-ের বিধান রয়েছে।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে কাজ চলছে।
বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র হস্তান্তরের পরই ফাঁসের ঘটনা ঘটছে বলে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতর এবং বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। ২০১০ সালের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কারও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি বলেও দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হালনাগাদ অন্তত ৮৩ বার বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রথম ব্যাপক আলোচনায় আসে। ওই ঘটনায় প্রথম তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়। হালনাগাদ বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অন্তত ৩৩ বার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি যথারীতি রিপোর্টও দিয়েছে। কিন্তু সেসব রিপোর্টে কমিটির সুপারিশ অধিকাংশই কার্যকর হয়নি।
সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায় ষষ্ঠ, সপ্তম ও নবম শ্রেণীর গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ কারণে উপজেলাটির ৪০টি উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আগামী ১৫ ডিসেম্বর স্থগিত হওয়া পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার তদন্ত চলছে। প্রায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। তবে আগের মতো আর ঢালাওভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে না।
২০১০ সালের ৮ জুলাই রংপুরে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং ভুয়া পরীক্ষার্থীর কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেটিই ছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতরা ভিন্নজগত নামে একটি বেসরকারী বিনোদন কেন্দ্রের তিনটি কক্ষ ভাড়া নেয়। সেখানে পরীক্ষার্থীদের আগাম পরীক্ষা নেয়ার সময় ৫ দালালসহ ১৬৭ জন পুলিশের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন পরীক্ষার্থী ছাড়াও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী হামিদুল হক, বিজি প্রেসের কর্মচারী, কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমান ও পটুয়াখালী সদর উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবুল বাশারসহ বিজি প্রেসের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী। গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় গবর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও বিজি প্রেসের বাইন্ডার লাবণী বেগম, পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম এ রউফ।
গ্রেফতারকৃতদের তথ্যমতে, বিজি প্রেসের ভেতর থেকে ট্রাঙ্কে রাখা প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দেয়া ২৮ লাখ টাকাসহ বিজি প্রেসের কর্মচারী আব্দুল জলিল গ্রেফতার হয়। ঘটনার দীর্ঘ তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গোপনীয় শাখাসহ পুরো বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ত্রুটির চিত্র উঠে আসে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনেও জানানো হয়, বিজি প্রেসের প্রধান ফটক ও গোপনীয় শাখায় প্রবেশ ও বহির্গমনে কোন তল্লাশি না থাকায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি ঘটে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই একজন কর্মচারী অনায়াসে একটি ট্রাঙ্কে করে ২৮ লাখ টাকা নিয়ে বিজি প্রেসে ঢুকতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিজি ও জিপি প্রেসের চক্রটিই সব সময় প্রশ্ন বের করে আনা-নেয়ার দায়িত্ব পালন করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে পিএসসি ও বিজি প্রেসের অন্তত ১০ কর্মকর্তা। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমল থেকেই এই চক্রের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে পিএসসির বিতর্কিত সদস্য ড. মাহফুজুর রহমান ও তাঁর দুই ভাগ্নেসহ কয়েক পরিচালক কাজ করছিলেন। তাঁদের যোগসাজশেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছিল। এজন্য বিজি প্রেসের সার্বিক নিরাপত্তায় এপিবিএন’র (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) ৬২ সদস্যের সমন্বয়ে একটি বিশেষ নিরাপত্তা সেল গঠনসহ বিজি প্রেসের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ দেয়া হয়েছিল ওই বিশেষ প্রতিবেদনে।
বিজি প্রেস সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ মোতাবেক বিজি প্রেসের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। প্রবেশপথগুলোতে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর। গোপনীয় শাখার প্রবেশপথে বসানো হয়েছে পেপার ডিটেক্টর। গোপনীয় শাখার মুদ্রিত প্রশ্নপত্র সিলগালা করে রাখতে নতুন স্ট্রংরুম তৈরি করা হয়েছে। ছাপাকৃত সকল প্রশ্নপত্র স্ট্রংরুমে রাখা হচ্ছে। বিজি প্রেসের মনিটরিং সেলের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা সেলের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রশ্নপত্র স্ট্রংরুমে সিলগালা করা হয়ে থাকে। মূল গেট বন্ধের পর সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশের নিরাপত্তা রয়েছে। পুরো বিজি প্রেস সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিশেষভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে গোপনীয় শাখার কার্যক্রম। গোপনীয় শাখায় কর্মরতদের পুরো শরীর তল্লাশি করে ঢুকতে দেয়া হয়। বের হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো শরীর তল্লাশি করা হবে। তাদের কোন অন্তর্বাস ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। পকেটহীন নীল রঙ্গের পোশাক ব্যবহার করতে হয়। ট্রাউজারে কোন বেল্ট বা পকেট থাকে না।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ২০১০ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কঠোর নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশের পরই বিজি প্রেসের প্রশ্নপত্র শাখাকে অন্য মুদ্রণ শাখা থেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলা হয়। এমনকি প্রশ্নপত্র ছাপার গোপনীয় শাখা পুরোপুরি মূল প্রেস ভবন থেকেই আলাদা করা হয়। প্রশ্নপত্র শাখায় বসানো হয় মেটাল ডিটেক্টর, পেপার ডিটেক্টর, ভল্ট ডোর, ক্যামকোর্ডার, গোপন ক্যামেরা আর পর্যাপ্ত সিসিটিভি। গোপনীয় ইউনিটের প্রবেশপথ ও বিজি প্রেসের সাধারণ শাখার আলাদা আলাদা প্রবেশপথও তৈরি করা হয়।
বিজি প্রেসের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্ত প্রতিবেদন মোতাবেক বিজি প্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে ২০১০ সালের পর হালনাগাদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কারও জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি। ৩২টি সিসি ক্যামেরা দিয়ে প্রশ্নপত্র ছাপার গোপন শাখা সব সময় মনিটরিং করা হয়। প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর জেলা বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাদের আর কোন দায়িত্ব থাকে না। সেখান থেকেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা বেশি থাকে।
তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত থাকেন। এসব প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মাধ্যমেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এতে করে প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়া সহজ হবে। অনেক শিক্ষক বা প্রশ্নপত্র প্রণেতা বা অন্যদের অংশগ্রহণ কমে আসবে। পা-ুলিপি থেকে নির্বাচিত প্রশ্ন সরাসরি অটোমেশন পদ্ধতিতে প্লেট আকারে তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এতে গোপনীয়তা রক্ষা করা অনেক সহজ হবে। কয়েক হাত ঘুরে প্রশ্নপত্র তৈরির জটিলতা থাকবে না। যত হাত ঘুরে প্রশ্নপত্র তৈরি হবে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা তত বেশি থাকে। তাই অটোমেশন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরির প্রক্রিয়া চালু হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা অনেক কমে যাবে। এছাড়া পরীক্ষা শুরুর ২ ঘণ্টা আগে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পৌঁছানোর প্রস্তাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা বা থানা থেকে প্রশ্নপত্রগুলো সরবরাহ করার প্রক্রিয়া ও কার্যকারিতার বিষয় নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা চলছে।
তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের বিশেষ নিরাপত্তা সেল গঠিত হয়নি। তবে মিরপুর পুলিশ লাইন ও আনসারের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় ৬০ সদস্যের একটি দল নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
এরপর ২০১২ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও সরকারী চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিদর্শক মফিজুর রহমান মফিজ (৩৫) ১০ সহযোগীসহ ডিবির হাতে গ্রেফতার হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি আবারও ব্যাপক আলোচনায় চলে আসে। সহযোগীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় অত্যাধুনিক ঘড়ি সদৃশ ২০ মোবাইল ফোন ঘড়ি। গ্রেফতারকৃত চক্রটির সঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে প্রকাশ পায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রীর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হালে প্রশ্নপত্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও কর্মচারীদের মাধ্যমে মূলত প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বেশি ঘটছে। পরীক্ষা শুরুর আগে প্রশ্নপত্রের বান্ডেল খোলা হয়। এ সময় দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বা কর্মচারীর মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন দিয়ে প্রশ্নপত্র স্ক্যান করা হয়। এরপর স্ক্যান করা প্রশ্নপত্র ই-মেইলের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের অপর সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। তারা ভাল ছাত্রদের দিয়ে প্রশ্নের সমাধান করে। এরপর সমাধান করা উত্তর এসএমএসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের হাতে থাকা বিশেষ ডিভাইসযুক্ত হাতঘড়ি সদৃশ মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও সরকারী বিজ্ঞান কলেজ, ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিটি কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ, সরকারী তিতুমীর কলেজ ও বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁস সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। সিন্ডিকেটটি ২০০৯ সাল থেকে সক্রিয়। চক্রটির হাত ধরে সরকারী চাকরি পেয়েছেন অন্তত ৫ হাজার। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শুধু প্রশ্নপত্র আনা-নেয়ার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। আনা- নেয়ার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোন আশঙ্কা নেই। তারপরও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর প্রত্যেকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কিন্তু সব প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসে না। যেসব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ঢালাওভাবে ফাঁস হয় শুধু সেসব খবরই প্রকাশ পায়। একটি প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে বহু লোক জড়িত থাকেন। অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রশ্নপত্র তৈরি হয়ে থাকে। প্রশ্নপত্র সংক্রান্ত একাধিক কমিটি রয়েছে। প্রথমে প্রশ্নের খসড়া তৈরি হয়। এরপর বিভিন্ন হাত ঘুরে জমা হয় অধিদফতরে।
তিনি বলেন, হয়তো কোন প্রশ্নপ্রণেতা দশটি প্রশ্নের প্রস্তাব করেন। তার মধ্যে হয়তো একটি প্রশ্ন মূল প্রশ্নপত্রে জায়গা পায়। এভাবেই একেকটি প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। সমস্ত প্রশ্নপত্র এসে জমা হলে তা আলাদ স্ট্রংরুমে রাখা হয়। সেখান থেকে প্রশ্নপত্রগুলো নানা বিষয় অনুযায়ী পৃথক করে সিলগালা করা হয়। পরে তা রাখা হয় স্ট্রংরুমে। এরপর ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নিরাপত্তার কারণেই একাধিক প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করা হয়ে থাকে।
মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক একেএম মঞ্জুরুল হক প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালের পর প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও তাদের অধিদফতরের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলেনি। ২০১০ সালের পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বিজি প্রেসের আর কোন সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্রুত প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কারা জড়িত তা বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা জাতির মেরুদ- দুর্বল করে দিচ্ছে। তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এরা দেশদ্রোহী। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। অন্যথায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আস্তে আস্তে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
প্রসঙ্গত, এ পর্যন্ত বিসিএস, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, অডিট, এনবিআর, এটিইও, মেডিক্যাল, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, এসএসসি, এইচএসসি, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রায় ৩০ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার অভিযোগ ওঠে। প্রসঙ্গত, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বেআইনী বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-ের বিধান রয়েছে।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে কাজ চলছে।
তথ্যসুত্র: জনকন্ঠ