মো. সিদ্দিকুর রহমান | ১৫ এপ্রিল, ২০২১
স্বাধীনতা ৫০বছর পেরিয়ে গেলেও প্রাথমিকে নেই কোন ক্যাডার সার্ভিস। হাঁস-মুরগী, গাছপালার জন্যও ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান। বাংলাদেশে তৃণমূলের শিক্ষার ভিত মজবুত করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা নামে বিশাল জনগোষ্ঠীর মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকের মতো এত জনবল আর কোনো মন্ত্রণালয়ে নেই। একটু গভীরভাবে উপলদ্ধি করলে দেখা যাবে, এ দেশের শিশু শিক্ষার ব্যাপক দায়িত্ব নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এ মন্ত্রণালয়। সব মন্ত্রণালয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সব পর্যায়ের শিক্ষাদার কার্যক্রমের মধ্যে কঠিন হলো অবুঝ শিশুকে শিক্ষা দিয়ে মানব শিশুতে রূপান্তরিত করা।
বাড়িতে একটা ছোট্ট শিশু থাকলে সবার নজর থাকে তার ওপর। প্রাথমিক শিক্ষকদের অনুরূপভাবে অনেক শিশুর জন্য সদা সতর্কতার সাথে দেখভাল করতে হয়। কর্মকর্তা-মন্ত্রী শিশুদের হইচইর মাঝে কতক্ষণ অবস্থান করতে পারবেন জানিনা? শিশুদের প্রতি ভালবাসায় আবদ্ধ হয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা এ কঠিন কাজটি করে যাচ্ছেন। প্রাথমিকের মন্ত্রণালয়ও এ বিশাল কর্মযজ্ঞ করেও মাঝে মাঝে নানা অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। ভাবখানা এমন শিক্ষার সব দায়িত্ব যেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্যদের। এ মন্ত্রণালয়কে অনেকে অবুঝ মন্ত্রণালয়ের মতো কম গুরুত্বহীন মনে করে থাকেন। আমাদের সংশ্লিষ্টরা অবুঝ শিশুর মতো তাদের ভাবনার মাঝে আবদ্ধ।
শিক্ষক হিসেবে আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে আমরা সবচেয়ে কঠিন শিক্ষা দানের কাজটি করে থাকি। সংশ্লিষ্টদেরও ভাবতে হবে আমাদের মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সব মন্ত্রণালয়ের মতো সমান সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির অধিকারী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। অথচ স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডারবিহীন। প্রাথমিক শিক্ষায় মেধাবী উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি অভিজ্ঞতাকে গুরুত্বহীন করে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বিঘ্ন সৃষ্টি করাও কাম্য নয়। একজন কৃষকের সন্তান বাবা-মায়ের সাহচর্যে থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে ভালভাবে পরবর্তীতে কৃষিকাজ করে থাকেন। অনুরূপভাবে একজন সহকারী শিক্ষক দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন। যার ফলে তার পদোন্নতির পথ সুগম হলে তার পক্ষে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।
এ বাস্তবতা শুধু বৃক্ততা-বিবৃতি ও কথার ফুল-ঝুড়ির মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে ভাবনা, সংশ্লিষ্টদের মাঝে দৃশ্যমান নয়। শুধু দৃশ্যমান হচ্ছে শিক্ষকরা তেল দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টদের। এভাবে ক্ষণিকের স্বার্থ রক্ষায় শেষ পর্যন্ত তেল গড়াচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপরও। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি বন্ধ। চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদোন্নতি না পেয়ে অবসর গ্রহণ বা মারা যাচ্ছেন। চলতি দায়িত্বে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের ক্যাডারবিহীন পদোন্নতি চালু আছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস?
প্রাথমিক শিক্ষকদের পদোন্নতি নামক সোনার হরিন সীমাহীন আকাশের দিগন্ত রেখার মত পিছিয়ে যাচ্ছে। ডিজি, সচিব, প্রতিমন্ত্রী, মহোদয়ের বক্তব্যে আশার বাণী শুনলে মনে হয় শতভাগ সহকারী শিক্ষকের প্রধান শিক্ষক পদোন্নতি অতি সন্নিকটে। সময়ক্ষেপন এমন এক পর্যায়ে যা সীমাহীন আকাশের মত দেখা যায়। এ বুঝি একটু পথ পেরুলেই আকাশকে স্পর্শ করা যাবে। শিক্ষকদের মনে প্রশ্ন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের চলতি দায়িত্ব খুব তাড়াতাড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়। অথচ চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষকরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ বৈষম্য বঞ্চনা প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কেন? শতকরা ৩৫ ভাগ প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগ চলছে। যার ফলে শিক্ষকতায় যোগ্যতাসম্পূর্ণ নিয়োগ হয়ে অভিজ্ঞতাহীন প্রধান শিক্ষককে ভরপুর হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়।
যার ফলে অনেক বিদ্যালয়ে অভিজ্ঞতাবিহীন সাবেক ছাত্র প্রধান শিক্ষকের সাথে অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক হৃদয়বিদারক শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। আরও ক্ষত বিক্ষত হয় শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতাবিহীণ সহকারী উপজেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার নামে সাবেক শিক্ষার্থীর সাথে। অভিজ্ঞতা ছাড়া কর্মকর্তা শিক্ষকের শিক্ষক হিসেবে কাজ করে কতটুকু মানসস্মত প্রাথমিক বাস্তবায়নে সক্ষম হবে? শিক্ষকদের মানসিক যন্ত্রণা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ঢাকা শহর ব্যতিরেকে সারাদেশের শিক্ষকেরা তবু বুক ভরা আশা নিয়ে বেঁচে আছেন, একদিন তাদের পদোন্নতির সুযোগ হবে। ঢাকা শহরে শূন্যপদে প্রধান শিক্ষক সহকারী শিক্ষকের পদ বাহিরের জেলা থেকে বদলি করে ভরপুর করে রেখেছে।
বর্তমান করোনা সংক্রামিত হওয়ার মতো। হাসপাতালে রোগীর আই.সি.ইউ, অক্সিজেন ও সিটের সংকট। এ সংকট মোকাবিলা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সংক্রমণরোধ করা প্রয়োজন। ঢাকা শহরের শিক্ষকদের সারাদেশের শিক্ষকদের মতো পদোন্নতির ও পোষ্যের কোটা পাওয়ার অধিকার আছে। সে প্রেক্ষাপটে নীতিমালা ভঙ্গ করে আর বাইরের জেলা থেকে বদলি করে ঢাকা শহরের শিক্ষকদের অধিকারকে সংক্রমিত করে নিঃশেষ না করার আহ্বান রইল। নীতিমালা ভঙ্গ করে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলা ৩ বছরের স্থলে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারবৃন্দ ৭-১০ বছর যাবৎ একই কর্মস্থল থেকে শিক্ষকদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছেন।
তারা করোনার স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক বিদ্যালয়ের জন্য তাপমাত্রা মাপাসহ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বিদ্যালয় কেনার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিভিন্নস্থানে প্রাথমিকের কর্মকর্তরা বহু বছর বা ঘুরে ফিরে একই স্থানে থেকে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন একই স্থানে দীর্ঘ সময় থাকা কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়টি দেখবেন বলে আশা করি। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষার সব অনিয়ম, দুর্নীতি, শূন্যের কোটায় নামিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নীতি বাস্তবায়নে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্টি ধরে শতভাগ পদোন্নতি সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ক্যাডার সৃষ্টি করে শিক্ষার উন্নয়ন ও অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে উঠবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা।
জয় বাংলা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।
সুত্র: দৈনিক শিক্ষাডটকম