কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নার্সিং কোর্স করা ২০ হাজার নার্সের সার্টিফিকেট নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সনদ ও নম্বরপত্র জালিয়াতির দায়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্টসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গেয়েন্দা পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা নার্সদের জাল সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সনদ পাওয়া এই নার্সদের তালিকা। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নার্সিং কাউন্সিলের একশ্রেণির কর্মকর্তা জড়িত বলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রুলস অব বিজনেস অ্যালোকেশন অনুসরণ না করে এবং বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) আইন-বিধান ভঙ্গ করে কারিগরি বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে নিবন্ধন দেওয়া হয়। অ্যানালিস্টসহ পাঁচ জন ডিবি অফিসে জ্ঞিজাসাবাদে বলেছেন, কারিগরি বোর্ডের অধীনে নার্সিং কোর্স ছিল, সেখানে জাল সার্টিফিকেটও অনেককে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্স চালু করার জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নার্সিং কাউন্সিলে আবেদন করেছিল কারিগরি বোর্ড।
ঐ সময় সরকারি নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট, চিকিত্সকদের একাধিক সংগঠন ও নার্সদের সংগঠন থেকে প্রতিবাদ আসে।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর আশপাশে সরকারের স্বীকৃত নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজ রয়েছে। নার্সিং কারিকুলাম, হাতেনাতে পরীক্ষা দেবে, প্রশিক্ষণ দেবে সেই ব্যবস্থা আছে। আইসিইউ ও সিসিইউসহ অপারেশন থিয়েটার ব্যবস্থাপনার সব ধরনের প্রশিক্ষণ হাতে কলমে নার্সদের শিখানো হয়। এরপর ধাপে ধাপে তিন বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা পাশ করার পর তাদের ছয় মাস ইন্টার্নশিপ করতে হয়। এরপর তারা নার্সিং
কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশন পায়। অন্যদিকে বিএসসি নার্সিং কিংবা পাবলিক হেলথ নার্সিং কোর্স করতে হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা অনুষদের অধীনে। অন্যদিকে কারিগরি বোর্ডের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নেই, হাসপাতাল নেই। এ কারণে তত্কালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলে দিয়েছিলেন, কারিগরি বোর্ডের অধীনে নার্সিং কোর্স চালু করা সম্ভব না।
পরে নানা কৌশলে নার্সিং কোর্স চালু করে দিয়েছিল কারিগরি বোর্ড। এই চালুর পিছনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত। কারিগরি বোর্ড ৯৪টি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ডিপ্লোমা পাশ করা ২০ হাজার নার্সকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য তালিকা পাঠায় নার্সিং কাউন্সিলে। তবে নার্সিং কাউন্সিলের কর্মকর্তারা দেখতে পান, কারিগরি বোর্ডের ওয়েবসাইটে তাদের তালিকা দেওয়া নেই। এতে তাদের সন্দেহ হয়। কয়েক দফা পাশের তালিকা ওয়েবসাইটে দিতে বললেও তারা দেয়নি।
এদিকে ২০ হাজার নার্স তাদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। নার্সিং কাউন্সিল ঘেরাও করেন। অপ্রীতিকর নানা ঘটনা ঘটে, ভাঙচুর করা হয়। দাবি আদায়ে তারা উচ্চ আদালতে যান। হাইকোর্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। পরে আন্দোলনকারীরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ থেকে জানিয়ে দেয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা হবে।
গতকাল এসব কথা জানান নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, ওয়েবসাইটে নাম দেওয়ার জন্য কয়েক বার বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি। এতে তাদের প্রশিক্ষণ আদৌ সঠিক কি না, এ নিয়ে আমাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকে।
একাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, এটা তাড়াতাড়ি করার জন্য নার্সিং কাউন্সিলকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, কমিটির মতামত অনুযায়ী ঐ ২০ হাজার নার্সের ধাপে ধাপে ছয় মাসের একটা পরীক্ষা নেওয়া হবে। সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে গিয়ে তারা পরীক্ষা দেবে। সরেজমিনে রোগীদের সেবা করবে। এই পরীক্ষায় পাশ করলে তাদের নার্সিং ও মিডওয়াফারি তাদের রেজিস্ট্রারভুক্ত করবে। ঐ সময় কারিগরি বোর্ডের অধীনে আর কোনো নার্সিং কোর্স পরিচালিত হবে না বলেও মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
ঐ সময় আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা তো কারিগরি বোর্ড থেকে এত পাশ করিনি। ৫ হাজারের মতো কোর্স করেছি। বাকিরা কোথা থেকে পাশ করল। নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তারা ঐ সময় এই ধরনের তথ্য জানিয়েছে। যেহেতু জাল সার্টিফিকেট দিয়েছে বর্তমান ও সাবেক অ্যানালিস্ট। এমন তথ্য-প্রমাণ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পেয়েছেন। তাদের আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হবে বলে কর্মকর্তারা জানান।
গতকাল সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা নার্সদের জাল সার্টিফিকেট দেওয়ার পিছনে জড়িত ছিলেন। তাদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য, নার্সিং কাউন্সিলের একাধিক কর্মকর্তাও জড়িত। নার্সিং কাউন্সিলের বর্তমান ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তারকে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গতকাল দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার পদ পাওয়া এবং অবৈধ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তাকে আগামী ২ মে সকাল ১০টায় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাজির হওয়ার সময় স্বামী-সন্তানের এনআইডি, পাসপোর্টের সত্যায়িত কপি সঙ্গে আনতে বলা হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন চিকিত্সকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকের প্রশ্ন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কীভাবে ২০ হাজার নার্সকে প্রশিক্ষণ দিল। চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ভর্তি রোগী, আইসিইউ, সিসিইউয়ের রোগীদের সেবা দেবেন নার্সরা। এটা প্রশিক্ষিত নার্স ছাড়া সম্ভব না। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের মতো কাজটি করেছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। রোগী মারার কল পেতেছে কারিগরি বোর্ড। টাকা কামানোর রাস্তা খুলছে। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নার্সিং কাউন্সিলের যারা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবহিত না। তবে বিষয়টি আমি দেখব।’
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হলো জবাবদিহিতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠিকেও অবজ্ঞা করা হয়। যদি জবাবদিহিতা থাকতো, তাহলে অনভিজ্ঞ নার্স সৃষ্টির মতো এমন স্পর্শকাতর ঘটনা ঘটত না। সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই ঘটনার পেছনে যারা জড়িত তাদের ধরা হোক। তাদের উপযুক্ত শাস্তি হলে এই ধরনের সর্বনাশা কাজ করার দুঃসাহস আর কেউ দেখাবে না।’