নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে না : ব্যাংকের আবগারি শুল্ক তিন স্তরে

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে মূল্য সংযোজন কর বা ভাট আইনের বাস্তবায়ন দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই ঘোষণা দেন। ঈদের ছুটির পর গতকাল সংসদের মূলতবি বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে নতুন ভ্যাট আইনের কার্যকারিতা দুই বছর পেছানোর আহ্বান জানান। আগে থেকেই অবশ্য বলা হয়েছিলো যে, প্রস্তাবিত ভ্যাট আইনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে খোলাসা বক্তব্য দেবেন।

গত পহেলা জুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনকালে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। এই আইনে ঢালাও   ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয় যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে শুরুতেই সমালোচনায় পড়ে। সংসদ এবং সংসদের বাইরে ভ্যাট আইনটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত গতকাল এর সমাধান দেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো যে, আইনটির কার্যকারিতা দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হতে পারে।

অর্থমন্ত্রী গতকাল জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যে কর আরোপ প্রক্রিয়ায় মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থাকে একটি উত্তম পন্থা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ১৯৯১ সালে প্রণীত মূল্য সংযোজন কর আইনটি বহু সংশোধনীর পর অফলপ্রসূ হয়ে পড়ায় ২০০৮ সালেই একটি নতুন মূসক আইন প্রণীত হয়। এইটি নিয়ে প্রায় চার বছর নানা আলোচনা বিতর্ক চলে। অবশেষে ২০১২ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যা এই মহান সংসদে পাস হয়।

তিনি বলেন, এই আইনটির কার্যকারিতা কিন্তু ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে। এ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পূর্ব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিধায় এবারের বাজেটে আইনটি কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো। এ বিষয়ে সংসদ সদস্যরা তাদের প্রাজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। সেই প্রেক্ষিতে মূসক আইনের পূর্ণ কার্যকারিতা পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করছি। আগের ধারাবাহিকতায় কিছু সংশোধন করে ২০১২ সালের আইনই যেভাবে গত ৪ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ঢালাও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের বিষয়টি আর থাকছে না। এখন থেকে আগের গত চার বছর ধরে চলে আসা নিয়মই বহাল থাকবে। তবে ক্ষেত্রেভেদে কিছু পরিবর্তন হতে পারে। অর্থমন্ত্রীও কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব প্রস্তাবসহ অর্থ বিল ২০১৭ জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়।

আবগারি শুল্ক কমেছে: এদিকে, বহুল আলোচিত আবগারি শুল্ক হারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। ব্যাংকে টাকা লেনদেনের ওপর আরোপিত আবগারি শুল্ক নিয়েও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। আগে ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বছরে দেড়শ’ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হতো। নতুন বাজেটে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মওকুফ করে দিয়ে ১ লাখের বেশি হলে ৮শ টাকা শুল্ক আরোপ করা হয় যা আগে ছিলো ৫শ  টাকা। আলোচনা সমালোচনার পর এই হারেও পরিবর্তন আনা হয়। তিনটি স্তরে এই পরিবর্তনের ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।

সংশোধিত প্রস্তাবে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনে আবগারি শুল্ক হার মওকুফ করা হয়। ১ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দেড়শ টাকা, ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫শ টাকা, ১০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত আড়াই হাজার টাকা শুল্কারোপের প্রস্তাব করা হয়। ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার বেশি হলে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক কর্তনের নতুন প্রস্তাব দেয়া হয়।

আরো যেসব সংশোধনী: অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আরও কিছু সংশোধনীর কথা তুলে ধরেন। তিনি সংসদে জানান, রাজস্ব প্রস্তাব সম্বন্ধে বিভিন্ন মহল থেকে শুল্ক-করাদি বাড়ানো অথবা কমানো অথবা বাদ দেয়ার জন্য অনেক প্রস্তাব গত কয়েক মাসে পাওয়া গেছে। জাতীয় সংসদের আলোচনায় এই সব প্রস্তাবের অনেকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই সব প্রস্তাবের বেশিরভাগই বাজেট চূড়ান্তকরণের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে একটি সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করে এবং ধ্যান অথবা যোগ (মেডিটেশন)-এর ওপরে আগামী ২ বছর ভ্যাট থাকছে না। কম্পিউটার, সেলুলার ফোন এবং তার যন্ত্রাংশ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে জানিয়ে এগুলোকে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। বহাল থাকছে শিপব্রেকিংয়ের বিষয়ে বর্তমানে বলবত প্রজ্ঞাপন। মোটরসাইকেল শিল্পের উপর স্থানীয় উত্পাদন পর্যায়ে আরোপনীয় সমুদয় মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেড অনেক সফটওয়্যার আমদানি করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রদান করে এবং কতিপয় পণ্য বিনা আমদানি শুল্কে আমদানি করে। যেসব পণ্যে আমদানি শুল্ক  নেই  সেগুলোর উপরে প্রস্তাবিত ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। রেফ্রিজারেটর সংযোজনকারীদের উপর প্রযোজ্য ৩০ শতাংশের স্থলে ২০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

এলপিজির ব্যাপক ব্যবহারের লক্ষ্যে কম্পোজিট অর্থাত প্লাস্টিক ও গ্লাস ফাইবার নির্মিত এলপিজি কন্টেইনারের ওপর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার এখনো আমদানি নির্ভর হওয়ায় স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে আমদানি পর্যায়ে লৌহনির্মিত এলপিজি কন্টেইনারের ওপর ভ্যাট বহাল রাখার প্রস্তাব করছি। এক কথায় গত বছর যে ব্যবস্থাটি ছিলো সেটাই অব্যাহত থাকছে।

অর্থমন্ত্রীর সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের সব যন্ত্রপাতি উত্পাদনকে সাহায্য করার জন্য গত বছরের অর্থ বিলে প্রগ্রেসিভ উত্পাদনকে কিছু কর/শুল্কের সুবিধা দেয়া হয়েছিলো। এবারও এই খাতের ওপর বর্ধিত শুল্ক করাদি মওকুফ করার প্রস্তাব রাখেন অর্থমন্ত্রী। একইভাবে প্রস্তাবিত সোলার প্যানেলের আমদানি শুল্ক বাদ দেয়া হয় চূড়ান্ত প্রস্তাবে।

Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।