নিজস্ব প্রতিবেদক,১২ জুন ২০২১
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। ইউরোপ আমেরিকাসহ প্রায় সব উন্নত দেশই রীতিমতো নাস্তানাবুদ। এই মহামারির ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশেও। প্রতিবেশী ভারতে ভয়ানক সংক্রমণের পর নতুন করে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা। অথচ এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ টিকার আওতায় আসেনি।
দেশে চলমান ভ্যাকসিনেশনের আওতায় এক কোটি ৬০ হাজার ৮৭১ জন টিকা পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৬ জন। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যা সবশেষ ১ জুলাই ২০১৯-এর হিসাবে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ৪৬ হাজার ১১৬ জন। মোট জনসংখ্যার হিসাবে টিকাগ্রহীতার সংখ্যা শতকরা ৬ দশমিক ১৭ ভাগ। এ হিসাবে দেখা যায় রীতিমতো ৯৩ দশমিক ৮৩ ভাগ লোক এখনো করোনার টিকাদান কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন।
তারা আদৌ টিকা পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে, দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তাও। এদিকে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ডেল্টা বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়্যান্ট ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে আবারো উদ্বেগ বাড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে মৃত্যু ও সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে অর্ধেকের বেশি জেলা শহরে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের উর্ধ্বগতির এ বাস্তবতায় প্রায় দেড় মাস ধরে গণটিকা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।
এছাড়া প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনতে গিয়ে তার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় আরেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে এখন কোন ধরনের করোনাভাইরাস বেশি ছড়াচ্ছে- সেটি খুজে দেখতে সংক্রমিত বিভিন্ন এলাকার ৫০টি নমুনার জিনম সিকোয়েন্সিং করে চারটি ধরন পাওয়া গেছে। চারটি ধরনের মধ্যে ৮০ শতাংশই ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়্যান্ট।
রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দেশ দুটিতে উদ্ভাবিত টিকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদনেরও। তবে এ চুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়া হয়নি। কবে নাগাদ এসব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়ে আমদানি ও উৎপাদন শুরু হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় কেউই। ফলে অনিশ্চয়তা কাটছে না কভিড মোকাবিলায় গণটিকা কর্মসূচি পুরোদমে চালু করা নিয়েও।
এ পর্যন্ত দেশে পাঁচ উদ্যোগে উদ্ভাবিত কোভিড প্রতিরোধী টিকা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। এগুলো হলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা, রাশিয়ার স্পুটনিক-৫, চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক উদ্ভাবিত টিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেকের উদ্ভাবিত টিকা। এর মধ্যে স্পুটনিক-৫, সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাকের টিকা ক্রয়ের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের কথাও এখন ভাবা হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা টিকা দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। এর দেড় মাসের মাথায় সেরাম থেকে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলে হুমকিতে পড়ে যায় পুরো কার্যক্রমটি। সংকট মেটাতে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা ক্রয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশ দুটি থেকে টিকা কেনার চুক্তির বিষয়টি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। তবে এ প্রক্রিয়া কবে নাগাদ চূড়ান্ত হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছেন না কেউই।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, মার্চে সেরাম ৫০ লাখের জায়গায় ২০ লাখ ডোজ পাঠানোর পর পরই বাংলাদেশের টিকার জন্য অন্যান্য উৎসে যোগাযোগ করা প্রয়োজন ছিল। শুধু সেরামের ওপর নির্ভর করে বসে থাকাটা উচিত হয়নি। পরে যখন এ নিয়ে উদ্যোগ নেয়া হলো, তত দিনে দেরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে ঠিকই। তবে দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অপেক্ষা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আপাতত সরকারের হাতে নেই।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, টিকা নিয়ে সরকারের চেষ্টায় ঘাটতি নেই। আমরা বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। চীন ও রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য উৎসেও টিকা চাওয়া হয়েছে।
এদিকে করোনার টিকার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ২০ ডোজ ফাইজারের টিকা দেশে এসেছে। এ জোট থেকে বাংলাদেশ করোনার টিকা পাবে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ। অন্যদিকে চীন থেকে উপহার পাওয়া সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ টিকা দিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চীন আরো ছয় লাখ ডোজ টিকা দেবে। ১৩ জুন ওই টিকা আসার কথা রয়েছে।
এদিকে দেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে আনা অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার মজুত রয়েছে মোটে দেড় লাখ। যদিও টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারীদের মধ্যে পৌনে ১৬ লাখ মানুষের এখনো দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেয়া বাকি। সংকটাপন্ন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেসব দেশের কাছে অক্সফোর্ডের টিকার পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গেও জরুরি ভিত্তিতে যোগাযোগ শুরু করেছে সরকার। এসব দেশের পক্ষ থেকে টিকাপ্রাপ্তির আশ্বাস মিলছে ঠিকই, তবে তা কবে নাগাদ আসবে, সে বিষয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
টিকা আমদানির জন্য গত বছরের নভেম্বরের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয় বাংলাদেশের। মূল্যও আগাম পরিশোধ করা হয়। কিন্তু গত মার্চের পর থেকে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না সেরাম। প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহে সংকটের আভাস মেলার পর থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় টিকাদান কর্মসূচির পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে সরকার। অনেকটা ঘাটতি নিয়েই গত ৮ এপ্রিল শুরু হয় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ। এ পর্যন্ত ১ কোটি ৬০ হাজার ৮৭১ জন নারী ও পুরুষ প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন ও দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৬ জন।
শুক্রবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এখনো দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেয়া বাকি ১৫ লাখ ৭৯ হাজার ১৫৯ জনের। এর বিপরীতে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মজুত রয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ডোজের কিছু বেশি। ফলে প্রথম ডোজ নেয়া সাড়ে ১৪ লাখ ব্যক্তির সময়মতো দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্তি পুরোপুরি অনিশ্চিত। দ্বিতীয় ডোজের টিকা শেষ হয়ে যাওয়ায় গতকাল ৪২ জেলায় টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীতে ৪৭ কেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ হয়েছে ২৭টি কেন্দ্রে। এ মুহূর্তে হাতে যে মজুত রয়েছে, তা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ফলে বাধ্য হয়েই অক্সফোর্ডের টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত টিকার ঘাটতি সামাল দিতে বাংলাদেশ প্রথমে যোগাযোগ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মে মাসের শুরুতে জরুরি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৪০ লাখ ডোজ টিকা চায় বাংলাদেশ। গত ৬ মে বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট আর্ল মিলারের সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব টিকা কবে নাগাদ দেশে আসবে, কেউই তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। এছাড়া আরো কয়েকটি দেশের হাতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বড় মজুত রয়েছে। সেসব উৎস থেকেও টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। সেসব টিকা হাতে আসা নিয়েও বড় ধরনের অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজের টিকার ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশকে টিকা পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে। সবাই বলে টিকা দেবে, কিন্তু হাতে আসছে না।
তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা হচ্ছে ২৫ মিলিয়ন। তারা টিকা সংগ্রহ করেছে ৯৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন। আমরা তাদের কাছে চেয়েছি। তারা বলেছে দেবে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকেও টিকা দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। আমরা জরুরি ভিত্তিতে তাদের কাছে টিকা চেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, আমাদের টিকা দেবে, তবে কবে দেবে সেটি এখনো বলেনি। তারা অক্সফোর্ড ও অন্যান্য টিকা কোভ্যাক্সের অধীনে দেবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, অক্সফোর্ডের টিকার প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তাদের আরো অনেক সময় অপেক্ষা করা লাগবে। কত সময় লাগবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের ব্যবধান যদি চার মাস বা পাঁচ মাসের হয়, তাহলেও চিন্তার কিছু নেই।