বিশেষ প্রতিনিধি: আজ ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত হয়। বাঙালির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি গৌরবময় অধ্যায়। একাত্তরের চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিশেষ অবদান সৃষ্টি করেছে। চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা ছিলো নেতৃস্থানীয় আর অবদান ছিলো অপরিসীম। কিন্তু সেই গৌরবগাঁথা ধরে রাখার কোনো জোরালো তাগিদ নেই। ইতিহাসই একটা জাতির পরিচয় বিবেকের অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চুয়াডাঙ্গার শ্রীমন্ত টাউন হল ছিলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম রনাঙ্গনের প্রধান কার্যালয়।
চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মোস্তফা আনোয়ারকে মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব দিয়ে এখানে বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ৪৪ বছর। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত চুয়াডাঙ্গায় কোনো স্মৃতিসৌধ নেই। ১৯৯৪ সালে শহীদ হাসান চত্বরে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও তা অবৈধ স্থাপনা হিসেবে ২০০১ সালে ভেঙে ফেলা হয়। পরবর্তীতে চুয়াডাঙ্গা মুক্তদিবসের কালের সাক্ষী মাথাভাঙ্গা ব্রিজ ঘেঁষে একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা যে অস্থায়ী প্রথম রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিলো সেখানেই নেই কোনো স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধের চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্যতম সংগঠক বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন চুয়াডাঙ্গার আট শহীদ স্মরণে আটকবরের পাশপাশি গড়ে তুলেছেন আট শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্স।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের টুআইসি কমান্ডার এমএ হান্নান বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে অংশ নেন চুয়াডাঙ্গা জেলার বেশ কয়েকজন যুবক। তাদের মধ্যে আমিও একজন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর চুয়াডাঙ্গায় সর্বপ্রথম ২০৪ জন মুজাহিদ ও আনসারকে একত্রিত করা হয়। জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় মেজর ওসমানগনি ও তদানিন্তন এমএলএ ডা. আসহাবুল হক হ্যাবা’র নির্দেশক্রমে ৫ এপ্রিল রাত ১২টার দিকে আমিনুল ইসলাম মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর অধিনায়ক হয়ে কুষ্টিয়া ভেড়ামারার পাকশি হার্ডিঞ্জব্রিজের অভিমুখে রওনা হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম পাক সৈন্যের সমানে অবরোধের দেয়াল গড়ে তোলে।
পাকবাহিনী যশোর থেকে ট্রেনযোগে এসে চুয়াডাঙ্গা প্রবেশ করে। আলমডাঙ্গা রেললাইনের পাশে পাকিস্তানি হানাদাররা ডাউন ট্রেন থামিয়ে স্বাধীনতাকামীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে পাশের মাছ বাজারে হত্যা করে সেখানে বধ্যভূমিতে পরিণত করে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ভুলু শেখ বলেন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গার মুক্তিবাহিনী ও নারীদের নির্যাতন করতো চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক কোয়ার্টারে। আর ওই কোয়ার্টার থেকে ৭ ডিসেম্বরের পরে পাওয়া যায় নারী-পুরুষের অজস্র গলিত লাশ। এখনও রাতে মুক্তিবাহিনী ও নারীদের আর্তচিৎকার কানে ভেসে আসে। ৭ ডিসেম্বরের পরে হাসপাতালের পরিত্যক্ত ড্রেন থেকে পাওয়া যায় মর্টার লান্সারসহ ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মুজাহিদ হাবিলদার কালু শেখ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গ্রুপ কমান্ডার বলেন, ৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী মেহেরপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা ২৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে চুয়াডাঙ্গার দিকে আসে। অপরদিকে দর্শনার দিক থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সাথে যোগ দিয়ে চুয়াডাঙ্গার মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হয়। ওইদিন এ খবর পেয়ে সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজটি পাকবাহিনী বোমা বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দেয়। যাতে মুক্তিবাহিনী তাদের অনুসরণ করতে না পারে। কিন্তু দর্শনার দিক থেকে আসা মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গাই এলে ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার মধ্যে পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা শহর ও আলমডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেলে চুয়াডাঙ্গা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু হোসেন বলেন, বর্তমান জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার সহযোদ্ধা শহীদ রবিউল ইসলাম ও শহীদ তোফাজ্জেলসহ যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে তাদের এখনও পর্যন্ত কবর শনাক্ত করা হয়নি তাদের কবর শনাক্ত করা প্রয়োজন, একই সাথে অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কারার আশা ব্যক্ত করেন।