শরীফুল আলম সুমন,১০ জুলাই ২০১৯ :
টাঙ্গাইলের মধুপুর কলেজ জাতীয়করণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি লাভ করে ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট। এরপর জাতীয়করণের গেজেট জারি হয় গত বছরের ১২ আগস্ট। জাতীয়করণের কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ওই কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি অবসরে যাবেন চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণ হওয়ার সুযোগ খুবই কম। ফলে কলেজ জাতীয়করণের পর এর সুবিধা না নিয়েই অবসরে যেতে হবে রফিকুল ইসলামকে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে তিনি মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
রফিকুল ইসলামের মতো এমন সমস্যায় ভুগছেন প্রায় আট হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। চাকরি আত্তীকরণের আগে যাঁরা অবসরে যাবেন তাঁরা জাতীয়করণের কোনো সুবিধা পাবেন না। এমনকি সরকারি শিক্ষক হিসেবেও পরিচয় দিতে পারবেন না। অথচ কলেজ জাতীয়করণের পর থেকে সবাই তাঁদের সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবেই জানে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সব কলেজের জাতীয়করণের গেজেট জারি হয়। এরপর আট মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও একটি কলেজেরও শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি সরকারীকরণ হয়নি। অথচ একই সময়ে জাতীয়করণ হওয়া শতাধিক স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি সরকারীকরণের কাজ শেষ হওয়ার পথে।
সূত্র মতে, খুবই ধীরগতিতে চলছে কলেজ জাতীয়করণের কাজ। এতে সরকারীকরণের সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে। এ ছাড়া যেসব শিক্ষক-কর্মচারী খণ্ডকালীন ও অস্থায়ী চাকরি করছেন, তাঁরাও দ্বিধায় ভুগছেন।
জানা যায়, জাতীয়করণের বিষয়ে সম্মতির পরই নতুন করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় ২৯৯ কলেজে। তখন ওই সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ হাজার। এর মধ্যে শিক্ষক ১২ হাজার ৩৫৬ জন এবং কর্মচারী প্রায় চার হাজার। তবে যে গতিতে আত্তীকরণের কাজ চলছে, তাতে সব কলেজের কাজ শেষ করতে চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। আর ওই সময়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে চলে যাবেন।
জাতীয়করণ হওয়া কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল হক বলেন, ‘২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর আমাদের কলেজগুলোতে নিয়োগ বন্ধ। কিন্তু এর মধ্যেই দুই হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে চলে গেছেন। আর আত্তীকরণে যদি পাঁচ বছর লাগে, তাহলে মোট শিক্ষক-কর্মচারীর ৬০ শতাংশই অবসরে চলে যাবে। সেই সংখ্যা হবে আট হাজারের ওপরে। আমরা আত্তীকরণপ্রক্রিয়া দ্রুত করতে এখন স্থানীয় সংসদ সদস্যদের স্মারকলিপি দিচ্ছি। এরপর শিক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেব। এতে অবস্থার উন্নতি না হলে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কারণ জাতীয়করণ হওয়ার পর বেসরকারি শিক্ষক হিসেবে অবসরে যাওয়া যে কতটা কষ্টের, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না।’
এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মো. মাহমুদ-উল-হক বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু কলেজের দিক থেকে সমস্যা হচ্ছে। নিয়োগ, এমপিওসহ নানা কাগজ দিতে তারা দেরি করছে। আর সব কাগজ পাওয়ার পরও অনেক প্রসেস শেষ করতে হয়। মাউশি অধিদপ্তর থেকে আমাদের কাছে পাঠাবে। আমরা জনপ্রশাসনে পাঠাব। তারা কাজ শেষ করে আমাদের ফেরত পাঠালে পরিপত্র জারি হবে। তবে দ্রুত আত্তীকরণের কাজ শেষ করতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
আত্তীকরণের আগে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যাপারে মাহমুদ-উল-হক বলেন, ‘আত্তীকরণ বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ীই সব কাজ সম্পন্ন করা হবে। যাঁরা আত্তীকরণ হওয়ার আগেই অবসের যাবেন তাঁরা সরকারীকরণের সুবিধা পাবেন না। তাঁরা এমপিওভুক্তির অবসরের যেসব সুবিধা রয়েছে, সেগুলো পাবেন। আর যাঁরা অস্থায়ী বা খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন তাঁরাও বিধিমালা অনুযায়ী আত্তীকৃত হতে পারবেন না।’
জানা যায়, ২৯৯ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কোন প্রক্রিয়ায় আত্তীকরণ বা সরকারীকরণ করা হবে সে সিদ্ধান্ত নিতেই শিক্ষা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘ সময় চলে যায়। সব কলেজে সমন্বিত পদ সৃজন করার অংশ হিসেবে গত বছরের ২৩ অক্টোবর ঢাকার চারটি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি নিয়ে সভা করে। সভায় কলেজগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণে ১৫ দফা তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিবের প্রত্যয়নসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর প্রতি মাসের ১৫ ও ৩০ তারিখে ১৮টি করে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য মাউশি অধিদপ্তরকে পাঠাতে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
মাউশি অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই চার কলেজকে মডেল হিসেবে ধরে কাজ এগোতে পারছে না অধিদপ্তর। তাদের প্রত্যেক শিক্ষকের সব ধরনের তথ্যই আলাদাভাবে যাচাই করতে হচ্ছে। কিন্তু কলেজ উইংয়ে মাত্র তিনজন সহকারী পরিচালকের পক্ষে এত বড় কাজ গুছিয়ে আনা কঠিন। এ জন্য এই কাজে আরো ৯ জন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। তারা সর্বশেষ ২০টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও নানা সমস্যায় তা ফেরত পাঠানো হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে আত্তীকরণের কাজ শেষ হতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে।
জানা যায়, শিক্ষক নিয়োগ যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়েছে কি না বা প্রাপ্যতা সঠিক আছে কি না, এসব যাচাই করে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বে থাকা ডিসি বা ইউএনও সব কাগজপত্র মাউশিতে পাঠাচ্ছেন। মাউশি ১৫ দফা তথ্য যাচাই করে সার্টিফায়েড কপি পাঠাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। তারা প্রয়োজনীয়তা যাচাই করে অনুমোদন দেবে। এরপর তা পাঠানো হবে অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন অনুবিভাগ ও প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায়। সেখান থেকে ফিরে আসার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা আত্তীকরণের পরিপত্র জারি করবে।
মাউশি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তারা একটি কলেজের সব শিক্ষক-কর্মচারীর তথ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে। তবে প্যাটার্ন অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিকের ঐচ্ছিক প্রতিটি বিষয়ের জন্য একজন, ডিগ্রির ঐচ্ছিক প্রতিটি বিষয়ের জন্য দুজন, অনার্স কলেজের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক সাতজন এবং মাস্টার্স থাকলে ১২ জন শিক্ষকসহ বিধি মোতাবেক নিয়োগ পাওয়া অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারীর আত্তীকরণ হওয়ার সুযোগ আছে। তবে অনেক কলেজেই শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় অস্থায়ী অথবা খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যেমন সাভার কলেজে প্যাটার্নের বাইরে ২৬ জন অস্থায়ী শিক্ষক থাকার তথ্য পেয়েছে মাউশি অধিদপ্তর। সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ওই শিক্ষকরা আত্তীকরণপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।