প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদা ও আজকের আন্দোলন

sarup pic

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড মর্যাদাসহ বিভিন্ন দাবিতে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা  চেয়ার বর্জন ও কর্মবিরতি পালন করেছেন।

যুক্তরাজ্য দলের দলনেতা ড. জেফ এর ভাষায় , প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার কারণে সমাজে ওনার স্ট্যাটাসের কোনো অবনতি যেমন হয়নি, তেমনি তাঁর আর্থিক অবস্থারও তেমন কোনো হেরফের হয়নি। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আপনি অনেক উচ্চশিক্ষিত, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক পাবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। কারণ, সেখানে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলই কেবল নেই, আছে যোগ্যতা অনুসারে সম্মানীর ব্যবস্থাও। কাজে যাঁদের আগ্রহ আছে, শুধু তাঁরা নন, যাঁদেরকে প্রয়োজন, তাঁরা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হন না।

আসলে কি তাই? প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকতা বরং অনেক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের রিসার্চ গাইডেন্স ছাড়া যে শিক্ষকতা, তার চেয়ে কঠিন বৈ সোজা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন পরিণত শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করতে আসেন। এর আগের ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে তাঁর কিছু না কিছু ধ্যানধারণা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলোর বিকাশ হয়। হয় বলে অনেক জায়গায় দূরশিক্ষণে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি দেওয়া যায়। কিন্তু আপনি অনেক খুঁজেও এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বের করতে পারবেন না, যেখানে দূরশিক্ষণে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা হলো বুনিয়াদি শিক্ষা।

এই সময়ে একজন শিক্ষার্থীর মনোজগৎ গড়ে ওঠে। তাই শিক্ষার্থীর বয়স, চাহিদা, ভালো লাগা না-লাগা বা মনোভাব ইত্যাদির প্রতি খেয়াল রেখে শিক্ষককে শিখনের পরিবেশ তৈরি করতে হয়। সেখানে ভুল করার অবকাশ কম।

প্রাথমিক শিক্ষককে তাঁর বিষয়গুলোতে যেমন খুবই দক্ষ হতে হয়, তেমনি শিক্ষার দর্শন, শিক্ষার সাইকোলজি ইত্যাদি বিষয় চিন্তা করে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে খুবই দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হয় যেন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন সম্ভব হয়। যত বেশি তাঁর এক্সপোজার থাকবে, ততই তিনি কুশলী শিক্ষক হবেন। তাঁর জানার ব্যাপ্তি হতে হবে অনেক বেশি। কারণ, শিশুমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়, যার জবাব দিতে হলে উত্তরদাতার জ্ঞানের পরিধি অনেক বেশি হতে হয়।

আবার কোন পদ্ধতিতে উত্তর করবেন, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হয়। এখানে ফাঁকি দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুল শিখেই বড় হবে। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাতে এটা কোনোভাবেই দাবি করা যাবে না যে একজন এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার মূল ব্যাপারগুলোতে সিদ্ধ হয়ে ওঠেন। কাজেই একজন এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে খুবই উন্নত শিক্ষক হবেন, এমনটা আশা করা বাতুলতা। যদিও তাঁর জন্য অনেক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
আমার মনে হয়, প্রাথমিক শিক্ষকদের যোগ্যতা কমিয়ে রাখার সম্ভবত অন্য একটি কারণ আছে এবং সেটি আর্থিক। সম্ভবত বললাম কারণ, এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা আমি কোথাও পাইনি। বাংলাদেশ মনে হয় বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা হলো তৃতীয় শ্রেণীর।

শুধু মর্যাদা নয়, একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন স্কেল হলো চার হাজার ৭০০ টাকা এবং তিনি সব মিলিয়ে আট হাজার টাকা পান প্রতি মাসে। অন্যদিকে সরকারি গাড়িচালকদের বেতন স্কেল পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা এবং তাঁদের মোট বেতন হয় ১০ হাজার টাকার বেশি। সম্প্রতি সংবাদপত্রের জন্য যে অষ্টম ওয়েজ বোর্ডের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেখানে একজন পিয়নের শুরুর বেতন ধরা হয়েছে এর দ্বিগুণ। পোশাকশ্রমিকদের মজুরিও কমপক্ষে আট হাজার টাকা করার উদ্যোগ রয়েছে।
আবার শিক্ষাদানই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একমাত্র কাজ নয়। মাঠপর্যায়ে যত সরকারি অনানুষ্ঠানিক কাজ, সবই তাঁদের করতে হয়। ভোটার তালিকা সংশোধন করতে হবে, তো পাঠাও প্রাইমারি টিচারদের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ করতে হবে—প্রাইমারি শিক্ষকেরা তো আছেন। বাচ্চাদের কৃমিনাশক বড়ি বা ভিটামিন ‘এ’ খাওয়াতে হবে—লোক তো আছে!
সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক দিন আগে তাঁর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিত মশাইয়ের মাধ্যমে আমাদের সমাজে শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন। সেই সময়ের পণ্ডিতদের ‘পাণ্ডিত্য ছিল অন্যান্য শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি কিন্তু সম্মান এবং পারিশ্রমিক এঁরা পেতেন সবচেয়ে কম। শুনেছি কোনো কোনো স্কুলে পণ্ডিতের মাইনে চাপরাসীর চেয়েও কম ছিল।’
সৈয়দ মুজতবা আলী যে সময়কার কথা বলেছেন, সেটি ব্রিটিশ আমলের কথা। এরপর পাকিস্তানি শোষণের সময় পেরিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি, তা-ও প্রায় ৪৪ বছর হয়ে গেল। প্রতিবছর যে তিন কোটি ছেলেমেয়ে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যায়, তাদের মধ্যে এক কোটির বেশি আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। যে মমতা আর স্নেহ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকেরা তাদের গড়ে তুলছেন, তাঁদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি কিংবা তাঁদের সচ্ছল রাখার জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই?

স্বরুপ দাস

সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা

আহবায়ক (খুলনা বিভাগ)

বাসপ্রাবিপ্রশিস

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।