প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা ৩য় শ্রেণি না ২য় শ্রেণি!

এস কে দাস: জাতি গঠনের কারিগর খ্যাত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সরকার দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছে এক বছর তিনমাস হতে চলল। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদাপ্রাপ্ত অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের মতো তাদের বেতন কাঠামো দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর সূদুর প্রসারি প্রভাব শিক্ষা ব্যবস্থার উপর পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা। এ ধরনের বৈষম্য থাকলে এখানে মেধাবিরা শিক্ষক হিসেবে আসবে না বলেও মনে করছেন তারা। এবিষয়ে সরকারের জরুরি পদক্ষেপ দাবি করেছেন শিক্ষক নেতারা।

জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মতো পুলিশের এসআই, নার্স ও ব্লক সুপারভাইজার সকলে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা প্রাপ্ত। অন্যান্যদের প্রারম্ভিক বেতন ৮ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হলেও শিক্ষকদের বেলায় তা হয়েছে ব্যতিক্রম।

সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার পর যে বেতন স্কেল নির্ধারণ করেছে তাতে প্রধান শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ৬ হাজার ৪শ টাকা। তাও আবার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলে। বেতন কাঠামোর ১১ নম্বর গ্রেড অনুযায়ী এটা করা হয়েছে।

আর প্রশিক্ষণ ছাড়া প্রধান শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯শ টাকা। তারাঁ বেতন পাবেন ১২ নম্বর গ্রেডে। অথচ উল্লেখিত অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তারা ১০ নম্বর গ্রেডে (৮ হাজার) তাদের প্রারম্ভিক বেতন নিয়ে থাকেন। ২য় শ্রেণীতে উন্নীত করে নতুন বেতন স্কেল আপগ্রেড করার আগে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের ১৩ নম্বর গ্রেডে প্রারম্ভিক বেতন ছিল ৫ হাজার ৫শ টাকা। আর প্রশিক্ষণবিহীনদের ১৪ নম্বর গ্রেডে বেতন ছিল ৫ হাজার ২শ টাকা। বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রিয় নেতারা বলছেন, যারা সরাসরি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর চার বছরের বেশি সময় ধরে চাকরিতে আছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণীর মর্যাদাবান হিসেবে ঘোষণা করার কারণে টাইমস্কেল প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেননা তাঁদের বেতন নিয়ম অনুযায়ী দুইধাপ বাড়িয়ে নির্ধারণ করার সুযোগ আর থাকে না। প্রধান শিক্ষকদের চাকরির জ্যেষ্ঠতা গণনা করে বেতন নির্ধারণের নির্দেশনা দেয়া হয়নি নতুন স্কেলে।

শিক্ষক নেতৃবৃন্দ জানান, যেসব প্রধান শিক্ষক ২০০০ সালে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন তাদের বেসিক চলতি বছর ২০ সেপ্টেম্বর স্বাভাবিকভাবেই ১১ হাজার ১৫০ টাকা হত। নতুন কাঠামোতে আপগ্রেড না হলেও তারা এ সময়ে ১০ নম্বর গ্রেড পেয়ে উল্লেখিত বেতন ড্র করতেন। কিন্তু বেতন আপগ্রেডের পর ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ( নতুন স্কেল ঘোষণা) হতে ৪ বছর ৭ মাস পর ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গিয়ে ১০ নম্বর গ্রেডে উল্লেখিত বেসিকের সমান বেতন পাবেন। এক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রধান শিক্ষকগণ দীর্ঘ ৪ বছর ৭ মাস প্রতিবছর ৯৪৫ টাকা বেসিক কম পাবেন।

বেতন আপগ্রেড হলে প্রধান শিক্ষকদের স্কেল ও বেতন বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। এব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এত দিন প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর। এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর হয়েছেন। সরকার তাঁদের প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করার সাহস দেখাতে পারেনি। শিক্ষকরা প্রথম শ্রেণী না পেলে মেধাবীরা কেন সেখানে যাবে।

তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বলছে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন বাস্তবায়ন হয়েছে। তারা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় বেতন পাচ্ছেন।

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেতন ভাতা পাচ্ছেন। তবে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির বেতন কাঠামোর নিচের কাঠামোতে বেতন পাচ্ছেন।

কিন্তু এটি মানতে নারাজ শিক্ষকরা। তারা বলছেন, প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় বেতন পাচ্ছেন।

এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক সমিতির যুগ্ম আহবায়ক এস এম ছায়িদ উল্লা বলেন, ‘আমরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদমর্যাদায় আগের মতোই বেতন পাচ্ছি। আমাদের মর্যাদা বাড়ানো হলেও বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়নি। আমরা এর সুরাহা চাই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মেহেদী হায়াত আব্বাসী বলেন, ‘প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পেলেও তাদের বাই নেমে গেজেট না হওয়ায় নতুন স্কেলে বেতন দেয়া যাচ্ছে না। তারা এখন তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় বেতন পাচ্ছেন।’

প্রধান শিক্ষকরা দ্রুত পদমর্যাদা ও সমান বেতন স্কেল বাস্তবায়নের দাবি জানান বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতির খুলনা বিবাগের আহবায়ক স্বরুপ দাস । এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জরুরি হস্তক্ষেপ ও সুদৃষ্টি দাবি করেছেন প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতারা।

জানা যায়, গত বছর ১৮ মে প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদায় উন্নীত প্রধান শিক্ষকগণের Self Drawing ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ে মতামত প্রেরণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে অনুরোধ জানায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর একই বছরের ৭ আগস্ট প্রধান শিক্ষকগণকে Self Drawing কর্মকর্তা অর্থাৎ গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষিত হওয়া প্রয়োজন মর্মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মতামত জানায় এবং এ বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না করে বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত প্রধান শিক্ষকগণের বেতন নির্ধারণের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১৭ সেপ্টেম্বর পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ ২৭ নভেম্বর এক পত্রের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকগণ চাকুরী (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০০৯-এর ৭ (২) (৯) এর আলোকে এতদসংক্রান্ত প্রচলিত বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদের সকল আর্থিক সুবিধাসমূহ প্রাপ্য হবেন মর্মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়।

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান পিএসসি’র আওতাভুক্ত। প্রধান শিক্ষক পদে নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতি পিএসসি’র মাধ্যমে হলে কম সময়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেধাবী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রিয় আহবায়ক রিয়াজ পারভেজ বলেন, ‘বেতন স্কেলের বৈষম্য দূর করে পদমর্যাদা বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে প্রধান শিক্ষকদের নামীয় গেজেট প্রকাশ করা উচিত।

প্রধান শিক্ষক সমিতির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক নজরুল ইসলাম এবং প্রধান শিক্ষক সমিতির সিলেট বিভাগীয় আহবায়ক মো. আবুল হোসেন বলেন,‘প্রধান শিক্ষক পদে নতুন নিয়োগ ও পদোন্নতি পিএসসি’র আওতাভুক্ত থাকুক। কেননা, পিএসসি কম সময়ে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেধাবী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবে।

প্রধান শিক্ষক সমিতির যুগ্ম আহবায়ক জনাব খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী পে-স্কেল ঘোষণার পূর্বেই যাতে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে প্রধান শিক্ষকদের নামীয় গেজেট প্রকাশ করা হয় এবং বেতন স্কেলের বৈষম্য দূর করে ৮০০০/- টাকার স্কেল দেওয়া হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর জরুরি হস্তক্ষেপ ও সুদৃষ্টি প্রয়োজন।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘বিসিএস দিয়ে ঢোকা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন এক টাকা হলেও বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু সরকার শিক্ষকদের কেমনভাবে দেখে তা তাদের বেতন কাঠামো দেখলেই বোঝা যায়।’

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।