বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় রকমের টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক। সারা বিশ্ব শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিবার্য পরিণতিকে সাদরে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের চার মাস পরও পাশের দেশ তা মেনে নিতে পারেনি; বরং ভারত ঘুরেফিরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আনায় তিক্ততা বেড়ে চলেছে।
সর্বশেষ সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন। এ ছাড়া কলকাতা ও মুম্বাইয়ের বাংলাদেশ মিশনের কাছেও বিক্ষোভ হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনে হামলার প্রতিবাদে ইতিমধ্যে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনকে তলব করে নিন্দা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই মিশনে ভিসা সেবাসহ কনস্যুলার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। হামলার প্রতিবাদে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিক্ষোভ চলছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
আরো পড়ুন: এবার ভারতের হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষ ছাড়
সরকারের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে গত আগস্ট থেকে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, তা শুধু সাম্প্রতিক কালেই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে বিরলই বলা চলে। পাঁচ বছরে এই প্রথম ঢাকায় ভারতের কোনো হাইকমিশনারকে তলবের ঘটনা ঘটল। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি ও বক্তব্যের পাল্টা প্রতিবাদও বাংলাদেশ এই সময়কালে বেশ কয়েকবার পাঠিয়েছে। এরই মধ্যে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠক হতে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকায় এটিই হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক। অবশ্য গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আলোচনা হয়েছিল। ওই সময় তৌহিদ হোসেন দুই দেশের সম্পর্কের স্বার্থে পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব দেন।
জানতে চাইলে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ থেকে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকটি স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হলেও এবার ইতিহাসের জটিল এক সন্ধিক্ষণে তা হতে যাচ্ছে। ফলে অন্যবারের তুলনায় ঢাকায় পরিকল্পিত বৈঠকটির নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে চলমান অস্বস্তি দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ বৈঠকের ধারাবাহিকতায় দুই দেশের বিভিন্ন খাতের অন্য আলোচনাগুলোও শুরুর পরিবেশ তৈরি হবে।
সম্পর্কে নজিরবিহীন টানাপোড়েন
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা–দিল্লির সম্পর্কের অস্বস্তি, টানাপোড়েন দৃশ্যমান হতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার পর এক্সে একটি পোস্ট দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই পোস্টে মোদি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি তোলেন। এরপর ড. ইউনূস দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন। সেই ফোনালাপেও মোদি সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গটি তোলেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্য, বিবৃতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টে দুই প্রতিবেশী দেশের ‘সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়’ যে সরকারকেন্দ্রিক ছিল, সেটি আর গোপন থাকেনি। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তখন থেকে তিনি দিল্লিতেই আছেন। সেখান থেকে বিভিন্ন সময় দেওয়া তাঁর বক্তব্য সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে যে বাধা, সেটি বাংলাদেশ স্পষ্ট করেই বলেছে। যদিও শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের বিষয়ে ঢাকাকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি দিল্লি। এমন এক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় নিউইয়র্কে তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে জয়শঙ্করের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিছু মার্কিন নাগরিক নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এনে বিক্ষোভ করেছিলেন।
পরে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের পাশাপাশি সামাজিক পরিসরে ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য-বিবৃতির মাত্রা কমতে শুরু করলেও ভারতের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি ভারতের মূলধারার বেশ কিছু গণমাধ্যম যেন সংখ্যালঘু ইস্যুকে পুঁজি করে বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া, মিথ্যা আর অপতথ্যের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। এতে বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে সনাতন ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার ও ইসকন নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ।
এরই মধ্যে চিন্ময় ও ইসকন ইস্যু নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর লোকসভায় বক্তব্য দিয়েছেন। কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করব, যাতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়।’
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে বিধানসভায় বক্তৃতা করেন। আবার তাঁর সেই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন কংগ্রেস নেতা শশী থারুর। থারুর বলেছেন, কোন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের কীভাবে মোতায়েন করে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই মমতার।
টানাপোড়েনের মধ্যেও তিন বৈঠক
ঢাকা–দিল্লি সম্পর্কের নানা টানাপোড়েনের জেরে গত চার মাসে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকটি স্থগিত হয়ে গেছে। ১৮ থেকে ২০ নভেম্বর দিল্লিতে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা অক্টোবরের শেষ দিকে বৈঠকটি স্থগিত করার অনুরোধ জানালে সেটি পিছিয়ে দেওয়া হয়। তবে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে পানিবণ্টন, স্থলসীমান্ত ও স্থলবন্দরের বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে তিনটি বৈঠক বাংলাদেশ ও ভারতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবরে ঢাকায় যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা গঙ্গার পানিপ্রবাহ নিয়ে কারিগরি বৈঠক করেন। নভেম্বরে কলকাতায় স্থলসীমান্তবিষয়ক নিরাপত্তা কমিটি এবং একই মাসে স্থলবন্দরবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন দিল্লিতে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ৯ ডিসেম্বর সকালে ভারতের বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসবেন। এরপর সকালে তিনি পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। মধ্যাহ্নভোজ শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। সবশেষে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ওই দিন বিকেলে দিল্লি ফিরে যাবেন বিক্রম মিশ্রি।
সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মার্কিন মধ্যস্থতা
আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ঢাকা–দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে সচেষ্ট রয়েছে। এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর দিল্লি ও ওয়াশিংটনে এ নিয়ে নানা পর্যায়ে কথাবার্তা বলেছে। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আসার আগে দিল্লি সফর করেছিলেন মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। আবার ঢাকা সফর শেষে তিনি ওয়াশিংটন যাওয়ার আগে দিল্লিতে এক দিনের যাত্রাবিরতি করেন। ঢাকায় বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি দিল্লিতে ভারতের বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তাঁদের সেই আলোচনায় মূল অগ্রাধিকার ছিল ঢাকা-দিল্লির সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা।
গত শনিবার ওয়াশিংটনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যাতে ইতিবাচক পথে এগোয়, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সক্রিয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশে কী ঘটছে, তা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে পরস্পরের স্বার্থেই শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকটি আলোচনার জন্য একটা যথার্থ ফোরাম। দুই দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসাটা জরুরি। বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অস্বাভাবিক যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা স্বাভাবিক করার স্বার্থে বৈঠকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত ১৫ বছরের দুই দেশের সম্পর্কের সমীকরণকে একপক্ষীয় বলে মনে করে বাংলাদেশের জনগণ। জনপরিসরে এ আলোচনা বেড়েছে। তাই ভারতের উচিত, বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে অনুধাবন করে পরিবর্তিত সময়ের নিরিখে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ঘাটতি দূর করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুযোগ রয়েছে পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে।
Source: prothomalo.com