পাসপোর্টে ভোগান্তি

pasporitএসকেদাস: মিরপুরের বাসিন্দা নাসিমা বেগম। জরুরি কাজে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে চান তিনি। ফরম পূরণ করে ‘অতি জরুরি’ ক্যাটাগরিতে পাসপোর্ট করার জন্য টাকাও জমা দিয়েছেন। বলে দেওয়া সময়ে গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে তিনি তাঁর পাসপোর্ট পাননি। তথ্য ও অনুসন্ধান কেন্দ্র থেকে জানানো হলো, পাসপোর্ট সরবরাহ করতে আরো দু-তিন দিন সময় লাগবে। এ কথা জানার পর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেল নাসিমা বেগমকে।

শুধু তিনিই নন, গতকাল দুপুরে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে এমন আরো অনেককেই ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। তারা জানায়, এমনিতেই রোজার মাস, তার ওপর ভয়াবহ যানজট, এর মধ্যে পাসপোর্ট পেতে প্রতিদিন দৌড়ঝাঁপ তাদের চরম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। জানা গেল, প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার পাসপোর্ট সরবরাহের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেছে। সরবরাহের সময় পার হয়ে যাওয়া দেড় লক্ষাধিক পাসপোর্টপ্রার্থীর ভোগান্তির সঙ্গে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে আরো ১৮ থেকে ২০ হাজার পাসপোর্টপ্রার্থী। সব মিলিয়ে পাসপোর্টের জন্য অফিসগুলোর সামনে যেন হাহাকার চলছে। বিশেষ করে যারা চিকিৎসার্থে দ্রুত দেশের বাইরে যেতে চায় আর যারা নির্দিষ্ট দিনে দেশের বাইরে থাকার কথা, তাদের কাকুতিমিনতিতে পাসপোর্ট অফিসের কর্মীরাও যেন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন বিড়ম্বনার পেছনে আছে পাসপোর্ট অফিসের সার্ভার সমস্যা। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন অফিসের সার্ভারে সমস্যা শুরু ১১ দিন আগে। মাঝেমধ্যে সার্ভার কাজ করলেও বেশির ভাগ সময় থাকছে অকেজো। ফলে পাসপোর্ট (নতুন বা নবায়ন করা) প্রিন্ট দেওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সার্ভারের ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ অংশ ব্যবহার করে ফেলায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে। কিন্তু কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি।

এতে একদিকে যেমন পাসপোর্টপ্রার্থীরা সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছে, তেমনি পাসপোর্ট অফিসের কাউন্টারে দায়িত্ব পালনকারীদেরও নাজেহাল হতে হচ্ছে। কেউ কেউ তথ্য ও অনুসন্ধান কেন্দ্রে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে কাউন্টারের কর্মীদের সঙ্গে। একই অবস্থা দেখা গেছে পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায়ও। সেখানে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারছেন পাসপোর্ট হয়নি। ফলে লোকজন উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে কাউন্টারের কর্মীদের সঙ্গে। পাসপোর্ট অফিসের কর্মীরা

জানিয়েছেন, এ অবস্থা শুধু আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসেরই নয়, দেশের সব পাসপোর্ট অফিসেই। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, সারা দেশের পাসপোর্ট অফিসে ফরম জমা নেওয়াসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ হলেও পাসপোর্টের প্রিন্ট দেওয়া হয় কেবল আগারগাঁও অফিস থেকে।

উল্লেখ্য, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস ছাড়াও বিভাগীয় আঞ্চলিকসহ সারা দেশে আরো ৬৬টি পাসপোর্ট অফিস আছে।

পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হয়। গত ১১ দিন পাসপোর্ট প্রিন্ট করতে না পারায় এক লাখ ৬৫ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা যায়নি। ফলে ভীষণ চাপে পড়তে হচ্ছে পাসপোর্ট অফিসকে। আগারগাঁও অফিসের চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সারা দেশের পাসপোর্ট অফিসের চাপও।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সার্ভার পুরোদমে ঠিক হলে আমরাও পুরোদমে কাজ শুরু করব। তার পরও পাসপোর্ট প্রিন্টের জট খুলতে কয়েক দিন লেগে যাবে। সে ক্ষেত্রে পাসপোর্টপ্রার্থীদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’

সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) শিহাব উদ্দিন খান গতকাল বলেন, ‘সার্ভারের ক্যাপাসিটির ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কাজ চলছে। দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হজযাত্রী, দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যাওয়া এবং সরকারি কাজে যারা দেশের বাইরে যাবে—এমন জরুরি প্রয়োজনে যারা পাসপোর্ট করতে আসছে তাদের পাসপোর্ট করে দেওয়া হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সার্ভারের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কাজ অনেক দিন আগেই শুরু হয়েছে। কাজটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’

শেরে বাংলানগরের মো. আফতাব গতকাল দুপুরে জানান, তিনি বেশ কয়েক দিন আগে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে যে কাগজ দেওয়া হয়েছে তাতে ২০ জুন পাসপোর্ট ডেলিভারি দেওয়ার কথা। তিনি গত ২০ জুন পাসপোর্ট নিতে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে যান। সেদিন কাউন্টার থেকে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় তাঁর পাসপোর্ট হয়নি। দুই দিন পরে পেয়ে যাবেন। তাদের কথা অনুযায়ী গতকাল দুপুরে তিনি আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে যান। গিয়ে জানতে পারেন এদিনও তাঁর পাসপোর্ট হয়নি। কিন্তু কী কারণে পাসপোর্ট হয়নি, সে বিষয়ে কাউন্টার থেকে তাঁকে কিছু বলা হয়নি। এ ঘটনায় মো. আফতাব হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এইভাবে না ঘুরিয়ে বলে দিলেই পারত ঠিক কোন দিন পাসপোর্ট দিতে পারবে।’

জরুরি পাসপোর্ট বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত দেওয়া হচ্ছে—পাসপোর্ট অফিসের এমন বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি গতকাল ওই অফিসে গিয়ে। গতকাল দুপুরে এক ব্যক্তিকে পাসপোর্ট ডেলিভারি কাউন্টারের সামনে চেঁচামেচি করতে দেখা গেল। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, “চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে যাব। কিন্তু প্রতিদিনই তারা বলছে ‘কাল আসেন’। সব জানানোর পরও আমি তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাইনি।” এ সময় তাঁর পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল আরো অন্তত ৫০ জন। তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন গিয়ে ওই ব্যক্তিকে শান্ত করে কাউন্টারের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে যারাই কাউন্টারে গিয়েছে তাদের সবাইকে পাসপোর্ট হয়নি জানিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। জানতে চাইলে পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মী জানান, ১১ দিন ধরে এ অবস্থা চলছে। তাহলে সাধারণ মানুষকে এটা জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন—এমন প্রশ্ন করা হলে ওই কর্মী বলেন, ‘ওপরের নির্দেশ ছাড়া আমরা কিছু করতে পারি না। মানুষজন পাসপোর্ট না পেয়ে আমাদের সঙ্গে রাগারাগি করছেন, এটা তো আমাদেরও ভালো লাগে না।’

পাসপোর্ট অফিসের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, লাইনে থাকা কিছু কিছু লোককে পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে সেখানকার পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মী জানান, এগুলো আগে তৈরি হওয়া পাসপোর্ট। এ ছাড়া সার্ভারে মাঝে মাঝে কিছু কাজ হয়। কিছু কিছু নতুন পাসপোর্টও করা যাচ্ছে। সেগুলো দেওয়া হচ্ছে।’

চট্টগ্রামের পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্টের যে ফরম জমা পড়ে তাঁদের অফিসে, সেগুলো আগারগাঁও থেকে প্রিন্ট হয়ে সেখানে যায়। ফলে তাঁরাও সংকটে পড়েছেন।

আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট করতে আসা আবদুর রহিম অভিযোগ করেন বলেন, ‘আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। জমা দেওয়ার পর ছবি তুলতে গিয়ে গেছে আরো কয়েক ঘণ্টা। এখন পাসপোর্ট নিতে এসে দিনের পর দিন ভোগান্তি। সীমাহীন এই ভোগান্তি সমাধানের জন্য আমরা কার কাছে যাব। এর শেষ কোথায়?’

এ বিষয়ে কথা হলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রেজোয়ান গতকাল বলেন, ‘সার্ভারে সংকট হয়েছে। আমাদের ক্যাপাসিটি আছে এক কোটি পাসপোর্টের তথ্য সংরক্ষণের। আমাদের এখানে আমরা এর মধ্যেই এক কোটি ৪৩ লাখের তথ্য সংরক্ষণ করে ফেলেছি। ফলে সার্ভারের ক্যাপাসিটি সংকট হয়েছে। কাজ চলছে। এখন আমরা দৈনিক ১১ হাজার প্রিন্ট দিতে পারছি। চাহিদা আছে ১৫-২০ হাজারের।’ এ ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা চলছে। তবে যে জট লেগেছে তা কাটাতে কিছু সময় তো লাগবেই—এ মন্তব্যও করেন তিনি। কালের কন্ঠ

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।