৭৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসরের দীর্ঘদিন পরও পেনশন পাচ্ছেন না

ডেস্ক রিপোর্ট : প্রায় ৭৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসরের দীর্ঘদিন পরও পেনশন পাচ্ছেন না। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন ৪ বছর ধরে অফিসে অফিসে ঘুরছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি টাকাও পাননি। পরিকল্পিতভাবে আর্থিক সংকটের অজুহাত তুলে এদের ঘোরানো হচ্ছে। প্রাপ্য অর্থ না মেলায় অধিকাংশেরই শেষজীবন কাটছে নিদারুণ কষ্টে । অনেকেই বয়সের ভারে রোগাক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু অর্থ সংকটে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। অবসরের টাকা হাতে না পেয়ে শিক্ষকদের অনেকেই মারা গেছেন।
বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি মাসের বেতন থেকে ৬ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয়। এর মধ্যে ৪ ভাগ যায় অবসর সুবিধা বোর্ডে এবং বাকি ২ শতাংশ কল্যাণ ট্রাস্টে। দুই খাতের সঙ্গে সরকারি অর্থ যোগ করে শিক্ষকদের পেনশন দেয়ার কথা। সে অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসর ভাতা এবং কল্যাণ ভাতার জন্য আবেদন করেন। ৭৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ৪৫ হাজার আবেদন করেছেন অবসর সুবিধা বোর্ডে। এখান থেকে অবসর ভাতা দেয়া হবে। ৩০ হাজার আবেদন করেছেন কল্যাণ ট্রাস্টে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী শুক্রবার বিকালে বলেন, মূলত আর্থিক সংকটের কারণে অবসরপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের আবেদন নিষ্পত্তিতে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে দেড়শ’ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অবসর বোর্ডে দেয়া হয়েছে একশ’ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবসর বোর্ডের একটি এফডিআর ভেঙে আরও ৭১ কোটি টাকার সংস্থান করা হয়েছে। এর বাইরে প্রতি মাসে সিডমানি থেকে প্রাপ্য মুনাফা বাবদ ৭২ কোটি টাকা এসেছে। আমরা এখন এই ২৪২ কোটি টাকা বণ্টন করব। এতে ১০-১২ হাজার শিক্ষকের দাবি মেটানো সম্ভব হতে পারে। আর কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, আমার এখানে প্রায় ৩০ হাজার আবেদনকারী আছেন। ইতিমধ্যে সরকারের বিশেষ বরাদ্দের ৫০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিডমানির মুনাফা মিলিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত দেড় থেকে পৌনে ২ হাজার শিক্ষকের দাবি মেটানো যাবে। উভয় কর্মকর্তা বলেন, ৭৫ হাজার শিক্ষকের পেনশন দাবি পূরণে কমপক্ষে আড়াই হাজার কোটি টাকা লাগবে। এর মধ্যে অবসর বোর্ডের জন্য লাগবে ১৮শ’ কোটি টাকা। আর কল্যাণ ট্রাস্টে লাগবে অন্তত ৬শ’ কোটি টাকা। বড় আকারের বিশেষ বরাদ্দ ছাড়া শিক্ষকদের দুর্ভোগ লাঘব কিছুতেই সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে। বছরের পর বছর একই চেয়ারে বসে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নানাভাবে অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের হয়রানি করছেন। যে কারণে আবেদন করে তাদের বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে। অর্থ সংকট দেখিয়ে অনেককে প্রাপ্য দেয়া হয় না। অনেকে নির্দিষ্ট সময় পর অর্থ পাওয়ার উপযোগী হন। এমনকি তাদের পেনশনের চেকও হয়ে যায়। কিন্তু ঘুষ না দিলে চেক মেলে না। নাম প্রকাশ না করে অবসর বোর্ডের এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জন্য এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তার কারণেই ৪৫ হাজার আবেদনের পাহাড় জমেছে। তিনি শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে কেটে রাখা ৪ শতাংশ অর্থ দিয়ে কিছু দাবি মেটাতে পারতেন। কিন্তু সে পথে না গিয়ে ওই কর্মকর্তা রহস্যজনক কারণে সরকারি ব্যাংক থেকে এই টাকা তুলে বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) করেন। বিষয়টি নিয়ে অডিট আপত্তি উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে গত মার্চে অবসর বোর্ডের এক সভায় এফডিআর ভেঙে শিক্ষকদের পেছনেই ব্যয়ের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অর্থই এখন শিক্ষকদের দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও একটি অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এফডিআরে ৭১ কোটি ৩৯ লাখ ৫ হাজার ৮১০ টাকা রাখা হয়েছিল। ওই টাকার মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। এখন এফডিআরের লাভের টাকা শিক্ষকদের না দিয়ে অফিস খরচের জন্য রাখা হবে। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত জুনে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অবসর ও কল্যাণ তহবিলে দেড়শ’ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ এবং অবসর বোর্ডে ৫শ’ কোটি টাকা সিডমানি বরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়। এর প্রায় ৬ মাস পর গত ডিসেম্বরে বিশেষ বরাদ্দের টাকা পাওয়া যায়। অবসর বোর্ডের একটি নথিতে দেখা যায়, ১শ’ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। ওই টাকা ব্যয়ের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অবসর বোর্ডকে দেয়া হয় গত ১৮ ডিসেম্বর। সেই টাকার সঙ্গে আরও দুই খাতের (এফডিআর এবং সিডমানির মুনাফা) প্রায় ১৪২ কোটি টাকা মিলিয়ে এখন অবসর সুবিধা দেয়া হবে। সব মিলিয়ে এ খাতে মোট অর্থ দাঁড়িয়েছে ২৪২ কোটি টাকা।
অবসর সুবিধা বোর্ডের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত ৪১ হাজার ৪৮টি আবেদন জমা পড়েছে। চলতি বছরের শেষ দশ মাসে আরও প্রায় ৪ হাজার আদেন জমা পড়ে। এসব আবেদন নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন ১৮শ’ কোটি টাকা। কল্যাণ ভাতার জন্য জমা পড়েছে ৩০ হাজার আবেদন।
এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর অবসর ভাতার জন্য যে আবেদন জমা পড়ে তা নিষ্পত্তিতে গড়ে ৪৩৬ কোটি টাকা প্রয়োজন। ১ বছরে বেতন থেকে কেটে নেয়া হয় ২১৬ কোটি টাকা। ঘাটতি থাকে ২২০ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণের জন্য বোর্ডের সভায় সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ সাদী বলেন, শিক্ষকদের দুর্দশা নিরসনে সরকারের বিশেষ বরাদ্দের বিকল্প নেই। যুগান্তর

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।