২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: ভিশন ও মিশন

প্রায় ১৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এর অধীনে সারাদেশের প্রায় ২৩০০ প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হয় শিক্ষা কার্যক্রম। দেশের সর্ববৃহৎ এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এখন ২টি বড় চ্যালেঞ্জ। একটি হলোÑ সেশনজট দূর করা, অন্যটি শিক্ষার মান নিশ্চিক করা। প্রায় ২ দশকে নানান প্রশাসনিক জটিলতা আর রাজনৈতিক প্রভাবে নেতিবাচকতায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা। ৪ বছরের অনার্স কোর্স সম্পন্ন করতে কারো কারো সময় লেগেছে ৬-৭ বছর। আর, কলেজে শিক্ষার মানও নিয়েও তৈরি হয়েছে নানান প্রশ্ন। বর্তমান প্রশাসন এই ২টি চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য ঘোষণা করেছেন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। ২০১৮ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত করার জন্য কাজ করছে একটি অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসক টিম। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বে ২ জন প্রোভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রারসহ বিরাট কর্মিবাহিনি কাজ করছেন নিরন্তর।
সেশনজটের কারণসমূহ প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে গ্রহণ করা হয়েছে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। ২জন পরীক্ষকের স্থলে এখন ১জন পরীক্ষককে উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাখা হয়েছে প্রধান পরীক্ষক। প্রতি ২০-২২ জন পরীক্ষকের মূল্যায়নকৃত উত্তরপত্র নিরীক্ষা করার পর ফলাফল প্রকাশের জন্য নম্বরপত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছে। উত্তরপত্র হাতে হাতে গ্রহণ ও প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পূর্বে ২জন পরীক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন করলে যে সময় যেত এবং পোস্টঅফিসের মাধ্যমে খাতা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে যে সময় লগতো, তা সম্পূর্ণভাবে রহিত করা সম্ভব হয়েছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ২/ আড়াই মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনার্স পর্বের ৩টি পরীক্ষা এবং ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফল খুব অল্প সময়ে প্রকাশ করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই কার্যক্রম হাতে নেওয়ায় গত ২ বছর সময়কালে প্রায় ১ বছর সেশনজট কমে গেছে। পরীক্ষা কমিটি গঠন, প্রধান পরীক্ষক ও পরীক্ষক প্যানেল তৈরিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। টিএমআইএস (টিচার্স ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) পদ্ধতির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত কলেজের প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক নিবন্ধিত হয়েছেন। অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা বিবেচনায় মনোনীত হচ্ছেন পরীক্ষক। একই ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরীক্ষা কমিটির সদস্য কিংবা পরীক্ষক না রেখে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে দেওয়া হচ্ছে এসব দায়িত্ব। প্রধান পরীক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি দেখা হচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যক শিক্ষককে পরীক্ষার কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে গাজীপুর ক্যাম্পাস থেকে সরাসরি উত্তরপত্র বিতরণের ব্যবস্থা পরিবর্তন করে বিভাগীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে স্থানীয়ভাবে শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে কাজের স্বচ্ছতা ও গতিশীলতার পাশাপাশি নিশ্চিত হয়েছে দায়িত্বশীলতাও। তবে, চলমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে কেবল ২য় বর্ষ এবং ৪র্থ বর্ষে মৌখিক পরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। ১ম বর্ষ এবং ৩য় বর্ষেও মৌখিক পরীক্ষা চালু করা প্রয়োজন। কেননা, ১ বছরে শিক্ষার্থী কী লেখাপড়া করলো, তা জানার জন্য শুধু লিখিত পরীক্ষা যথেষ্ট নয়। আর পর্যায়ক্রমিক মান উন্নয়নের জন্যও প্রতি বছরের কোর্স শেষে মৌখিক পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। আর ইন্টারনাল পরীক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি মৌখিক পরীক্ষায় ইন্টারনাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিভাগীয় প্রধান ও পরবর্তী ১ জন সিনিয়র শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কমিটিতে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বেশি সংখ্যক শিক্ষককে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ, একই ব্যক্তিকে সকল পরীক্ষার দায়িত্ব না দিয়ে পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষককে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। তাহলে জুনিয়ররাও কাজের সুযোগ পাবেÑতাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এই পদ্ধতি বেশ ফলপ্রসূও হবে।
২২ বছরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ভাষা ইনস্টিটিউট কিংবা ভাষা-শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়নি। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিনে প্রথমেই ভাষাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রশাসন সম্প্রতি গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে একটি ডিজিটাল ল্যাবসহ ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার এবং ৬টি প্রশাসনিক বিভাগে ৬ টি আঞ্চলিক কেন্দ্রে ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারের শাখা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই উদ্যোগের ফলে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে আরো একধাপ এগিয়ে গেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের শিক্ষার্থীরা থার্ড বা ফোর্থ ভাষা শেখার সুযোগ পাবে। প্রফেশনাল ডিগ্রিও গ্রহণ করতে পারবে আগ্রহীরা। এছাড়া, সরকারের সাথে যুক্তভাবে ভাষাশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে বিদেশে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল রফতানি কাজে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা শিখে বিদেশে গেলে আমাদের শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবিরা যেমন অধিক বেতনে চাকুরি করার সুযোগ পাবে, তেমনই পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে আমাদের রেমিটেন্স। বাড়বে দেশের সুনামও।
সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সকল ভর্তি, ভর্তি বাতিল, অভিভুক্তি, ফলাফল প্রকাশ, কলেজ পরিবর্তন, নবায়ন প্রভৃতি কাজে অনলাইন সার্ভিস চালু করেছে। ফলে দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী কলেজে কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে হাজির না হয়েও কিছু দরকারি কাজ সেরে নিতে পারছে। কলেজগুলোও তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও গতিময়তা উপভোগ করতে পারবে। এই উদ্যোগের ফলে প্রাসঙ্গিক কিছু জটিলতা ও দুর্নীতি (যদি থাকে) কমে আসবে। এছাড়া পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের সম্মানী পরীক্ষকের অ্যাকাউন্ট নম্বরে পাঠানোর জন্য চালু হয়েছে ‘সোনালী ব্যাংক সেবা সার্ভিস’। ফলাফল প্রকাশের পরপরই সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে প্রেরণ করা হচ্ছে তার প্রাপ্য টাকা। আগামী ২ বছরের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন সেবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একটি পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। তবে, অনলাইন সেবার পাশাপাশি একটি আপডেটেড ওয়েবপেজ নির্মাণ করাও জরুরি কাজ বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে, অ্যাকাডেমিক এবং ফ্যাকাল্টি বিষয়ক ইনফরমেশন যুক্ত হলে সারা বিশ্ব এই বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে আরো ভালোভাবে জানতে পারবে।
কলেজ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যেই শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বছরে প্রায় ১০০০ শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। যেসব কলেজ থেকে শিক্ষকরা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছেন, প্রশিক্ষণ শেষে ওইসব কলেজকে প্রদান করা হচ্ছে ২ হাজার (প্রতিটির জন্য) টাকা মূল্যমানের সিলেবাসভিত্তিক বই। এতে করে শিক্ষকের যোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কলেজের লাইব্রেরিগুলোও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে জার্নাল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে গত বছর থেকে চলছে ‘মাস্টার্স ইন অ্যাডভান্স স্টাডিজ’। বাংলা, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি, কম্পিউটার সায়েন্স, লাইব্রেরি সায়েন্সে চলছে এই প্রোগ্রাম। আগামী বছর ট্যুরিজমসহ আরো কিছু বিষয়ে চালু হবে থিসিস বেইজড এই বিশেষ মাস্টার্স ডিগ্রি। শিক্ষার্থীদের এইসব গবেষণা বা অভিসন্দর্ভ জাতীয় নীতি-নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। জাতীয় উন্নয়ন ও ভাবধারাকে সমুন্নত রাখতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির ভিশন বাস্তবায়নে বর্তমান মিশন সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা।

ড. ফজলুল হক সৈকত
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।